DJ Billal photo

DJ Billal photo
DJ Billal photo

বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৪

ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ) (صلاة الرسول صـ ছালাতের বিবরণ DJ BILLAL


ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ) (صلاة الرسول صـ
ছালাতের বিবরণ (صفة الصلاة) :
ছালাতের বিস্তারিত নিয়ম-কানূন বিভিন্ন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তবে নিম্নের হাদীছটিতে অধিকাংশ বিধান একত্রে পাওয়া যায় বিধায় আমরা এটিকে অনুবাদ করে দিলাম।-
‘হযরত আবু হুমায়েদ সা‘এদী (রাঃ) একদিন দশজন ছাহাবীকে বললেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত সম্পর্কে আপনাদের চাইতে অধিক অবগত। তাঁরা বললেন, তাহ’লে বলুন। তখন তিনি বলতে শুরু করলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ছালাতে দাঁড়াতেন, তখন (১) দুই হাত কাঁধ বরাবর উঠিয়ে তাকবীর বলতেন। অতঃপর ক্বিরাআত করতেন। অতঃপর তাকবীর দিয়ে (২) দু’হাত কাঁধ বরাবর উঠিয়ে রুকুতে যেতেন। এসময় দু’হাত হাঁটুর উপর রাখতেন এবং মাথা ও পিঠ সোজা রাখতেন। অতঃপর সামি‘আল্লা-হু লেমান হামিদাহ বলে রুকূ থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াবার সময় (৩) দু’হাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন। অতঃপর তাকবীর দিয়ে সিজদায় গিয়ে দু’হাত দু’পাঁজর থেকে ফাঁক রাখতেন এবং দু’পায়ের আঙ্গুলগুলি খোলা রাখতেন (‘ক্বিবলার দিকে মুড়ে রাখতেন’ -বুখারী হা/৮২৮; ঐ, মিশকাত হা/৭৯২)।
অতঃপর উঠতেন ও বাম পায়ের পাতার উপর সোজা হয়ে বসতেন, যতক্ষণ না প্রত্যেক হাড় স্ব স্ব স্থানে ঠিকমত বসে যায়। অতঃপর দাঁড়াতেন। অতঃপর দ্বিতীয় রাক‘আতেও এরূপ করতেন। অতঃপর যখন দ্বিতীয় রাক‘আত শেষে (তৃতীয় রাক‘আতের জন্য) উঠতেন, তখন তাকবীর দিয়ে দাঁড়িয়ে (৪) দু’হাত কাঁধ বরাবর এমনভাবে উঠাতেন, যেমনভাবে তাকবীরে তাহরীমার সময় উঠিয়েছিলেন। এভাবে তিনি অবশিষ্ট ছালাতে করতেন। অবশেষে যখন শেষ সিজদায় পৌঁছতেন, যার পরে সালাম ফিরাতে হয়, তখন বাম পা ডান দিকে বাড়িয়ে দিতেন ও বাম নিতম্বের উপর বসতেন (قَعَدَ مُتَوَرِّكًا)। অতঃপর সালাম ফিরাতেন’। এ বর্ণনা শোনার পর উপস্থিত দশজন ছাহাবীর সকলে বলে উঠলেন ‘ছাদাক্বতা’ (صَدَقْتَ), ‘আপনি সত্য বলেছেন’। এভাবেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত আদায় করতেন’।[1]
এক্ষণে ছালাতের বিশেষ মাসআলাগুলি পৃথক পৃথকভাবে নিম্নে আলোচিত হ’ল :
১. নিয়ত (النية) : ‘নিয়ত’ অর্থ ‘সংকল্প’। ছালাতের শুরুতে নিয়ত করা অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَاتِ وَ إِنَّمَا لِكُلٍّ امْرِءٍ مَّا نَوَى... ‘সকল কাজ নিয়তের উপরে নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাই-ই পাবে, যার জন্য সে নিয়ত করবে’....। [2] অতএব ছালাতের জন্য ওযূ করে পবিত্র হয়ে পরিচ্ছন্ন পোষাক ও দেহ-মন নিয়ে কা‘বা গৃহ পানে মুখ ফিরিয়ে মনে মনে ছালাতের দৃঢ় সংকল্প করে স্বীয় প্রভুর সন্তুষ্টি কামনায় তাঁর সম্মুখে বিনম্রচিত্তে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। মুখে নিয়ত পাঠের প্রচলিত রেওয়াজটি দ্বীনের মধ্যে একটি নতুন সৃষ্টি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাতে এর কোন স্থান নেই। অনেকে ছালাত শুরুর আগেই জায়নামাযের দো‘আ মনে করে ‘ইন্নী ওয়াজ্জাহ্তু...’ পড়েন। এই রেওয়াজটি সুন্নাতের বরখেলাফ। মূলতঃ জায়নামাযের দো‘আ বলে কিছু নেই।
২. তাকবীরে তাহরীমা ও বুকে হাত বাঁধা (التكبيرة التحريمة ووضع اليد اليمنى على ذراعه اليسرى على الصدر) :
দুই হাতের আংগুল সমূহ ক্বিবলামুখী খাড়াভাবে কাঁধ অথবা কান পর্যন্ত উঠিয়ে দুনিয়াবী সবকিছুকে হারাম করে দিয়ে স্বীয় প্রভুর মহত্ত্ব ঘোষণা করে বলবে ‘আল্লা-হু আকবার’ (আল্লাহ সবার চেয়ে বড়)। অতঃপর বাম হাতের উপরে ডান হাত বুকের উপরে বেঁধে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সম্মুখে নিবেদিত চিত্তে সিজদার স্থান বরাবর দৃষ্টি রেখে[3] দন্ডায়মান হবে। আল্লাহ বলেন, وَقُوْمُوْا ِللهِ قَانِتِيْنَ- ‘আর তোমরা আল্লাহর জন্য নিবিষ্টচিত্তে দাঁড়িয়ে যাও’ (বাক্বারাহ ২/২৩৮)। হাত বাঁধার সময় দুই কানের লতি বরাবর দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলী উঠানোর হাদীছ যঈফ। [4] ছালাতে দাঁড়ানোর সময় তাকবীরে তাহরীমার পর বুকে হাত বাঁধা সম্পর্কে প্রসিদ্ধ হাদীছগুলির কয়েকটি নিম্নরূপ:
১. সাহ্ল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন,
كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُوْنَ أَنْ يَّضَعَ الرَّجُلُ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى ذِرَاعِهِ الْيُسْرَى فِى الصَّلَوةِ، قَالَ أبو حَازِمٍ : لاَ أَعْلَمُ إِلاَّ يَنْمِىْ ذَالِكَ إِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ، رواه البخارىُّ-
‘লোকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হ’ত যেন তারা ছালাতের সময় ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখে। আবু হাযেম বলেন যে, ছাহাবী সাহ্ল বিন সা‘দ এই আদেশটিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিকে সম্পর্কিত করতেন বলেই আমি জানি’।[5]
‘যেরা‘ (ذِرَاعٌ) অর্থ কনুই থেকে মধ্যমা আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত দীর্ঘ হাত’ (আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব)। একথা স্পষ্ট যে, বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখলে তা বুকের উপরেই চলে আসে। নিম্নোক্ত রেওয়ায়াত সমূহে পরিষ্কারভাবে যার ব্যাখ্যা এসেছে। যেমন-
২. ছাহাবী হুল্ব আত-ত্বাঈ (রাঃ) বলেন,
رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَضَعُ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى عَلَى صَدْرِهِ فَوْقَ الْمَفْصِلِ، رواه أحمدُ- ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বাম হাতের জোড়ের (কব্জির) উপরে ডান হাতের জোড় বুকের উপরে রাখতে দেখেছি’।[6]
৩. ওয়ায়েল বিন হুজ্র (রাঃ) বলেন,
صَلَّيْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَوَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى يَدِهِ الْيُسْرَى عَلَى صَدْرِهِ، رواه ابْنُ خُزَيْمَةَ وَصَحَّحَهُ ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছালাত আদায় করলাম। এমতাবস্থায় দেখলাম যে, তিনি বাম হাতের উপরে ডান হাত স্বীয় বুকের উপরে রাখলেন’। [7]
উপরোক্ত ছহীহ হাদীছ সমূহে ‘বুকের উপরে হাত বাঁধা’ সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। ইমাম শাওকানী বলেন, وَلاَ شَيْءَ فِي الْبَابِ أَصَحُّ مِنْ حَدِيْثِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ الْمَذْكُوْرِ فِيْ صَحِيْحِ ابْنِ خُزَيْمَةَ- ‘হাত বাঁধা বিষয়ে ছহীহ ইবনু খুযায়মাতে ওয়ায়েল বিন হুজ্র (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের চাইতে বিশুদ্ধতম কোন হাদীছ আর নেই’।[8] উল্লেখ্য যে, বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখা সম্পর্কে ১৮ জন ছাহাবী ও ২ জন তাবেঈ থেকে মোট ২০টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে এর বিপরীত কিছুই বর্ণিত হয়নি এবং এটাই জমহূর ছাহাবা ও তাবেঈনের অনুসৃত পদ্ধতি।[9]
এক্ষণে ‘নাভির নীচে হাত বাঁধা’ সম্পর্কে আহমাদ, আবুদাঊদ, মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ প্রভৃতি হাদীছ গ্রন্থে চারজন ছাহাবী ও দু’জন তাবেঈ থেকে যে চারটি হাদীছ ও দু’টি ‘আছার’ বর্ণিত হয়েছে, সেগুলি সম্পর্কে মুহাদ্দেছীনের বক্তব্য হ’ল-لاَ يَصْلُحُ وَاحِدٌ مِنْهَا لِلْاِسْتِدْلاَلِ ‘(যঈফ হওয়ার কারণে) এগুলির একটিও দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়’।[10]
প্রকাশ থাকে যে, ছালাতে দাঁড়িয়ে মেয়েদের জন্য বুকে হাত ও পুরুষের জন্য নাভীর নীচে হাত বাঁধার যে রেওয়াজ চালু আছে, হাদীছে বা আছারে এর কোন প্রমাণ নেই। [11] বরং এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, ছালাতের মধ্যকার ফরয ও সুন্নাত সমূহ মুসলিম নারী ও পুরুষ সকলে একই নিয়মে আদায় করবে।[12]
বুকে হাত বাঁধার তাৎপর্য : ত্বীবী বলেন, ‘হৃৎপিন্ডের উপরে বুকে হাত বাঁধার মধ্যে হুঁশিয়ারী রয়েছে এ বিষয়ে যে, বান্দা তার মহা পরাক্রান্ত মালিকের সম্মুখে দাঁড়িয়েছে হাতের উপর হাত রেখে মাথা নিচু করে পূর্ণ আদব ও আনুগত্য সহকারে, যা কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ করা যাবে না’।[13]
৩. ছানা : ‘ছানা’ (الثناء) অর্থ ‘প্রশংসা’। এটা মূলতঃ ‘দো‘আয়ে ইস্তেফতা-হ’ (دعاء الاستفتاح) বা ছালাত শুরুর দো‘আ। বুকে জোড় হাত বেঁধে সিজদার স্থানে দৃষ্টি রেখে বিনম্রচিত্তে নিম্নোক্ত দো‘আর মাধ্যমে মুছল্লী তার সর্বোত্তম ইবাদতের শুভ সূচনা করবে। -(পৃষ্ঠা ১৩ দ্রষ্টব্য)।
৪. বিসমিল্লাহ পাঠ (التسمية) : ছানা বা দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ পাঠ শেষে ‘আঊযুবিল্লাহ’‘বিসমিল্লাহ’ নীরবে পড়বে। অতঃপর সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করবে। প্রকাশ থাকে যে, ‘আঊযুবিল্লাহ’ কেবল ১ম রাক‘আতে পড়বে, বাকী রাক‘আতগুলিতে নয়।[14] অমনিভাবে ‘বিসমিল্লাহ’ সূরায়ে ফাতিহার অংশ হওয়ার পক্ষে যেমন কোন ছহীহ দলীল নেই, [15] তেমনি ‘জেহরী’ ছালাতে ‘বিসমিল্লাহ’ সরবে পড়ার পক্ষে কোন নির্ভরযোগ্য ভিত্তি নেই।[16] বরং এটি দুই সূরার মধ্যে পার্থক্যকারী হিসাবে পঠিত হয়’ (কুরতুবী)[17]
ইমাম কুরতুবী বলেন যে, সকল কথার মধ্যে সঠিক কথা হ’ল ইমাম মালেকের কথা যে, ‘বিসমিল্লাহ’ সূরা ফাতিহার অংশ নয়’। যেমন ‘কুরআন’ খবরে ওয়াহেদ অর্থাৎ একজন ব্যক্তির বর্ণনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং তা প্রতিষ্ঠিত হয় অবিরত ধারায় অকাট্ট বর্ণনা সমূহের মাধ্যমে, যাতে কোন মতভেদ থাকে না। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, এটি সূরা ফাতিহার অংশ না হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এতে মতভেদ রয়েছে। আর কুরআনে কোন মতভেদ থাকে না। বরং ছহীহ-শুদ্ধ বর্ণনা সমূহ যাতে কোন আপত্তি নেই, একথা প্রমাণ করে যে, ‘বিসমিল্লাহ’ সূরা ফাতিহার অংশ নয়’। এটি সূরা নমলের ৩০তম আয়াত মাত্র। এ বিষয়ে ছহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি প্রণিধানযোগ্য’। [18]
(১) আনাস বিন মালিক (রাঃ) বলেন,
صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِيْ بَكْرٍ وَعُمَرَ وَعُثْمَانَ فَلَمْ أَسْمَعْ أَحَدًا مِّنْهُمْ يَقْرَأُ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ، رَوَاهُ أَحْمَدُ وَمُسْلِمٌ وَاِبنُ خُزَيْمَةَ- وَفِي روايةٍ : لاَ يَجْهَرُوْنَ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ-
অর্থ : আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর পিছনে ছালাত আদায় করেছি। কিন্তু তাঁদের কাউকে ‘বিসমিল্লাহ’ জোরে পড়তে শুনিনি’। [19]
(২) দারাকুৎনী বলেন, إنَّهُ لَمْ يَصِحَّ فِي الْجَهْرِ بِهَا حَدِيْثٌ ‘বিসমিল্লাহ’ জোরে বলার বিষয়ে কোন হাদীছ ‘ছহীহ’ প্রমাণিত হয়নি। [20]
(৩) তবে ছহীহ হাদীছ সমূহের বিপরীতে সবল-দুর্বল মিলে প্রায় ১৪টি হাদীছের প্রতি লক্ষ্য রেখে হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হয়তোবা কখনো কখনো ‘বিসমিল্লাহ’ জোরে বলে থাকবেন। তবে অধিকাংশ সময় তিনি চুপে চুপেই পড়তেন। এটা নিশ্চিত যে, তিনি সর্বদা জোরে পড়তেন না। যদি তাই পড়তেন, তাহ’লে ছাহাবায়ে কেরাম, খুলাফায়ে রাশেদীন, শহরবাসী ও সাধারণ মুছল্লীদের নিকটে বিষয়টি গোপন থাকত না’।.... অতঃপর বর্ণিত হাদীছগুলি সম্পর্কে তিনি বলেন, فَصَحِيْحُ تِلْكَ الْأَحَادِيْثِ غَيْرُ صَرِيْحٍ، وَصَرِيْحُهَا غَيْرُ صَحِيْحٍ ‘উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীছগুলির মধ্যে যেগুলি ছহীহ, সেগুলির বক্তব্য স্পষ্ট নয় এবং স্পষ্টগুলি ছহীহ নয়’।[21]
৫. (ক) সর্বাবস্থায় ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করার দলীল সমূহ-
(أدلة قراءة الفاتحة في الصلاة) :
ইমাম ও মুক্তাদী সকলের জন্য সকল প্রকার ছালাতে প্রতি রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা ফরয। প্রধান দলীল সমূহ :
(১) হযরত উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَّمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ، مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ(‘লা ছালা-তা লিমান লাম ইয়াক্বরা’ বিফা-তিহাতিল কিতা-ব’) ‘ঐ ব্যক্তির ছালাত সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করে না’। [22]
(২) ছালাতে ভুলকারী (مسئ الصلاة) জনৈক ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ... ثُمَّ اقْرَأْ بِأُمِّ الْقُرْآنِ وَبِمَا شَآءَ اللهُ أَنْ تَقْرَأَ ‘অতঃপর তুমি ‘উম্মুল কুরআন’ অর্থাৎ সূরায়ে ফাতিহা পড়বে এবং যেটুকু আল্লাহ ইচ্ছা করেন কুরআন থেকে পাঠ করবে’...। [23]
(৩) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, أُمِرْنَا أَنْ نَقْرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَمَا تَيَسَّرَ ‘আমরা আদিষ্ট হয়েছিলাম যেন আমরা সূরায়ে ফাতিহা পড়ি এবং (কুরআন থেকে) যা সহজ মনে হয় (তা পড়ি)’।[24]
(৪) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, أَمَرَنِيْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ أُنَادِيَ أَنَّهُ لاَ صَلاَةَ إِلاَّ بِقِرَاءَةِ فَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَمَا زَادَ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে নির্দেশ দেন যেন আমি এই কথা ঘোষণা করে দেই যে, ছালাত সিদ্ধ নয় সূরায়ে ফাতিহা ব্যতীত। অতঃপর অতিরিক্ত কিছু’।[25] এখানে প্রথমে সূরায়ে ফাতিহা, অতঃপর কুরআন থেকে যা সহজ মনে হয়, সেখান থেকে অতিরিক্ত কিছু পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
(৫) আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوْا لَهُ وَأَنْصِتُوْا... (‘ওয়া এযা কুরিয়াল কুরআ-নু ফাসতামি‘ঊ লাহূ ওয়া আনছিতূ’)। অর্থ : ‘যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর ও চুপ থাক’... (আ‘রাফ ৭/২০৪)
আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে বলেন, أَتَقْرَءُوْنَ فِيْ صَلاَتِكُمْ خَلْفَ الْإِمَامِ وَالْإِمَامُ يَقْرَأُ ؟ فَلاَ تَفْعَلُوْا وَلْيَقْرَأْ أَحَدُكُمْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فِيْ نَفْسِهِ، أَخْرَجَهُ ابْنُ حِبَّانَ- ‘তোমরা কি ইমামের ক্বিরাআত অবস্থায় পিছনে কিছু পাঠ করে থাক? এটা করবে না। বরং কেবলমাত্র সূরায়ে ফাতিহা চুপে চুপে পাঠ করবে’।[26]
(৬) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ صَلَّى صَلاَةً لَمْ يَقْرَأْ فِيْهَا بِأُمِّ الْقُرْآنِ فَهِيَ خِدَاجٌ، فَهِيَ خِدَاجٌ، فَهِيَ خِدَاجٌ، غَيْرُ تَمَامٍ ‘যে ব্যক্তি ছালাত আদায় করল, যার মধ্যে ‘কুরআনের সারবস্ত্ত’ অর্থাৎ সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করল না, তার ঐ ছালাত বিকলাঙ্গ, বিকলাঙ্গ, বিকলাঙ্গ, অপূর্ণাঙ্গ’...। রাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) -কে বলা হ’ল, আমরা যখন ইমামের পিছনে থাকি, তখন কিভাবে পড়ব? তিনি বললেন, إقْرَأْ بِهَا فِيْ نَفْسِكَ (ইক্বরা’ বিহা ফী নাফসিকা) ‘তুমি ওটা চুপে চুপে পড়’। তাছাড়া উক্ত হাদীছে সূরা ফাতিহাকে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে অর্ধেক করে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে وَلِعَبْدِيْ مَا سَأَلَ ‘আর আমার বান্দা যা চাইবে, তাই পাবে’।[27] ইমাম ও মুক্তাদী উভয়েই আল্লাহর বান্দা। অতএব উভয়ে সূরা ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’-এর সর্বোত্তম হেদায়াত প্রার্থনা করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ আমাদেরকে যেদিকে পথনির্দেশ দান করেছেন।
উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীছে সূরা ফাতিহাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১ম ভাগে আলহামদু... থেকে প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা এবং ২য় ভাগে ইহ্দিনাছ... থেকে শেষের তিনটি আয়াতে বান্দার প্রার্থনা এবং ইইয়াকা না‘বুদু...-কে মধ্যবর্তী আয়াত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যা আল্লাহ ও বান্দার মাঝে বিভক্ত। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ-কে শামিল করা হয়নি। ফলে অত্র হাদীছ অনুযায়ী বিসমিল্লাহ সূরা ফাতিহার অংশ নয়।
‘খিদাজ’ (خِدَاجٌ) অর্থ : সময় আসার পূর্বেই যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, যদিও সে পূর্ণাংগ হয় (আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব)। খাত্ত্বাবী বলেন, ‘আরবরা ঐ বাচ্চাকে ‘খিদাজ’ বলে, যা রক্তপিন্ড আকারে অসময়ে গর্ভচ্যুত হয় ও যার আকৃতি চেনা যায় না’। আবু ওবায়েদ বলেন, ‘খিদাজ’ হ’ল গর্ভচ্যুত মৃত সন্তান, যা কাজে আসে না’। [28] অতএব সূরায়ে ফাতিহা বিহীন ছালাত প্রাণহীন অপূর্ণাংগ বাচ্চার ন্যায়, যা কোন কাজে লাগে না।
(৭) হযরত ওবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) বলেন, আমরা একদা ফজরের জামা‘আতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পিছনে ছালাত রত ছিলাম। এমন সময় মুক্তাদীদের কেউ সরবে কিছু পাঠ করলে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ক্বিরাআত কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সালাম ফিরানোর পরে তিনি বললেন, সম্ভবতঃ তোমরা তোমাদের ইমামের পিছনে কিছু পড়ে থাকবে? আমরা বললাম, হ্যাঁ। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, لاَ تَفْعَلُوْا إِلاَّ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَإِنَّهُ لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِهَا ‘এরূপ করো না কেবল সূরায়ে ফাতিহা ব্যতীত। কেননা ছালাত সিদ্ধ হয় না যে ব্যক্তি ওটা পাঠ করে না’।[29]
ঘটনা এই যে, প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সাথে অনেকে ইমামের পিছনে সরবে ক্বিরাআত করত। অনেকে প্রয়োজনীয় কথাও বলত। তাতে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন ঘটতো। তাছাড়া মুশরিকরাও রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন পাঠের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে শিস দিত ও হাততালি দিয়ে বিঘ্ন ঘটাতো। সেকারণ উপরোক্ত আয়াত (আ‘রাফ ৭/২০৪) নাযিলের মাধ্যমে সকলকে কুরআন পাঠের সময় চুপ থাকতে ও তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে আদেশ করা হয়েছে।[30] এই নির্দেশ ছালাতের মধ্যে ও বাইরে সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। অতঃপর পূর্বোক্ত উবাদাহ, আবু হুরায়রা ও আনাস (রাঃ) প্রমুখ বর্ণিত হাদীছ সমূহের মাধ্যমে জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে কেবলমাত্র সূরায়ে ফাতিহা নীরবে পড়তে ‘খাছ’ ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অন্য কোন সূরা নয়।
অতএব উক্ত ছহীহ হাদীছ সমূহ পূর্বোক্ত কুরআনী আয়াতের (আ‘রাফ ৭/২০৪) ব্যাখ্যা হিসাবে এসেছে, বিরোধী হিসাবে নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে ‘অহি’ দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট, তাঁর নিজের পক্ষ থেকে নয়। অতএব অহি-র বিধান অনুসরণে সর্বাবস্থায় ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য।
৫. (খ) বিরোধীদের দলীলসমূহ ও তার জওয়াব
(أدلة المخالفين للقراءة وجوابها) :
ইমামের পিছনে জেহরী বা সের্রী কোন প্রকার ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা যাবে না -এই মর্মে যাঁরা অভিমত পোষণ করেন, তাঁদের প্রধান দলীল সমূহ নিম্নরূপ :
(১) সূরা আ‘রাফ ২০৪ আয়াতে ক্বিরাআতের সময় চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে তা শুনতে বলা হয়েছে। সেখানে বিশেষ কোন সূরাকে ‘খাছ’ করা হয়নি। এক্ষণে হাদীছ দ্বারা সূরায়ে ফাতিহাকে খাছ করলে তা কুরআনী আয়াতকে ‘মনসূখ’ বা হুকুম রহিত করার শামিল হবে। অথচ ‘হাদীছ দ্বারা কুরআনী হুকুমকে মানসূখ করা যায় না’। [31]
জবাব : এখানে ‘মনসূখ’ হবার প্রশ্নই ওঠে না। বরং হাদীছে ব্যাখ্যাকারে বর্ণিত হয়েছে এবং কুরআনের মধ্য থেকে উম্মুল কুরআনকে ‘খাছ’ করা হয়েছে (হিজর ১৫/৮৭)। যেমন কুরআনে সকল উম্মতকে লক্ষ্য করে ‘মীরাছ’ বণ্টনের সাধারণ আদেশ দেওয়া হয়েছে (নিসা ৪/৭,১১)। কিন্তু হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারী সন্তানগণ পাবেন না বলে ‘খাছ’ ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[32]
মূলতঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটেছিল কুরআনের ব্যাখ্যাকারী হিসাবে[33] এবং ঐ ব্যাখ্যাও ছিল সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট।[34] অতএব রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদত্ত ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করা ‘অহিয়ে গায়ের মাতলু’ বা আল্লাহর অনাবৃত্ত অহি-কে প্রত্যাখ্যান করার শামিল হবে।
(২) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা এক জেহরী ছালাতে সালাম ফিরিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছল্লীদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এইমাত্র আমার সাথে কুরআন পাঠ করেছ? একজন বলল, জি-হাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাই বলি, مَا لِيْ أُنَازِعُ القُرْآنَ ‘আমার ক্বিরাআতে কেন বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে’? রাবী বলেন,- فَانْتَهَى النَّاسُ عَنِ الْقِرَاءَةِ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْمَا جَهَرَ فِيْهِ ‘এরপর থেকে লোকেরা জেহরী ছালাতে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ক্বিরাআত করা থেকে বিরত হ’ল’।[35]
জবাব : হাদীছের বক্তব্যে বুঝা যায় যে, মুক্তাদীগণের মধ্যে কেউ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাথে সরবে ক্বিরাআত করেছিলেন। যার জন্য ইমাম হিসাবে রাসূল (ছাঃ)-এর ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। ইতিপূর্বে আনাস ও আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ দু’টিতে নীরবে পড়ার কথা এসেছে, যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন,فَإنْ قَرَأَ فَلْيَقْرَءِ الْفَاتِحَةَ قِرَاءَةً لاَ يُشَوِّشُ عَلَي الْإِمَامِ- ‘জেহরী ছালাতে মুক্তাদী এমনভাবে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করবে, যাতে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়’।[36] অতএব নীরবে ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতিহা পড়লে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টির প্রশ্নই আসে না। উল্লেখ্য যে, হাদীছের শেষাংশে ‘অতঃপর লোকেরা ক্বিরাআত থেকে বিরত হ’ল’ কথাটি ‘মুদরাজ’ (مدرج), যা সনদভুক্ত অন্যতম বর্ণনাকারী ইবনু শিহাব যুহরী কর্তৃক সংযুক্ত। শিষ্য সুফিয়ান বিন ‘উয়ায়না বলেন, যুহরী (এ বিষয়ে) এমন কথা বলেছেন, যা আমি কখনো শুনিনি’। [37]
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّمَا جُعِلَ الْإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوْا وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوْا- ‘ইমাম নিযুক্ত হন তাকে অনুসরণ করার জন্য। তিনি যখন তাকবীর বলেন, তখন তোমরা তাকবীর বল। তিনি যখন ক্বিরাআত করেন, তখন তোমরা চুপ থাক’। [38]
জবাব : উক্ত হাদীছে ‘আম’ ভাবে ক্বিরাআতের সময় চুপ থাকতে বলা হয়েছে। কুরআনেও অনুরূপ নির্দেশ এসেছে (আ‘রাফ ৭/২০৪)। একই রাবীর (আবু হুরায়রা) ইতিপূর্বেকার বর্ণনায় এবং আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে সূরায়ে ফাতিহাকে ‘খাছ’ ভাবে চুপে চুপে পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব ইমামের পিছনে চুপে চুপে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করলে উভয় ছহীহ হাদীছের উপরে আমল করা সম্ভব হয়।
(৪) হযরত জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَةُ الْإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ ‘যার ইমাম রয়েছে, ইমামের ক্বিরাআত তার জন্য ক্বিরাআত হবে’।[39]
জবাব : (ক) ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, যতগুলি সূত্র থেকে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে সকল সূত্রই দোষযুক্ত। সেকারণ ‘হাদীছটি সকল বিদ্বানের নিকটে সর্বসম্মতভাবে যঈফ (إِنَّهُ ضَعِيْفٌ عِنْدَ جَمِيْعِ الْحُفَّاظِ)’।[40]
(খ) অত্র হাদীছে ‘ক্বিরাআত’ কথাটি ‘আম’। কিন্তু সূরায়ে ফাতিহা পাঠের নির্দেশটি ‘খাছ’। অতএব অন্য সব সূরা বাদ দিয়ে কেবল সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করতে হবে।
(৫) لاَ صَلاَةَ إِلاَّ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ (‘লা ছালা-তা ইল্লা বি ফা-তিহাতিল কিতাব’) বা ‘সূরায়ে ফাতিহা ব্যতীত ছালাত নয়’ [41] অর্থ ‘ছালাত পূর্ণাংগ নয়’ (لاَ صَلاَةَ بِالكَمَالِ) । যেমন অন্য হাদীছে রয়েছে, لاَ إِيْمَانَ لِمَنْ لاَ أَمَانَةَ لَهُ وَلاَ دِيْنَ لِمَنْ لاَ عَهْدَ لَهُ (‘লা ঈমা-না লিমান লা আমা-নাতা লাহূ, ওয়ালা দীনা লিমান লা ‘আহ্দা লাহূ’) ‘ঐ ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানত নেই এবং ঐ ব্যক্তির দ্বীন নেই যার ওয়াদা ঠিক নেই’[42] অর্থ ঐ ব্যক্তির ঈমান পূর্ণ নয়, বরং ত্রুটিপূর্ণ।
জবাব : (ক) কুতুবে সিত্তাহ সহ প্রায় সকল হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত উপরোক্ত মর্মের প্রসিদ্ধ হাদীছটি একই রাবী হযরত উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে দারাকুৎনীতে ছহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, لاَ تُجْزِئُ صَلاَةٌ لاَ يَقْرَأُ الرَّجُلُ فِيْهَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ- ‘ঐ ছালাত সিদ্ধ নয়, যার মধ্যে মুছল্লী সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করে না’।[43] অতএব উক্ত হাদীছে ‘ছালাত নয়’ অর্থ ‘ছালাত সিদ্ধ নয়’।
(খ) অনুরূপভাবে’ ‘খিদাজ’ বা ত্রুটিপূর্ণ- এর ব্যাখ্যায় ইবনু খুযায়মা স্বীয় ‘ছহীহ’ গ্রন্থে ‘ছালাত’ অধ্যায়ে ৯৫ নং দীর্ঘ অনুচ্ছেদ রচনা করেন এভাবে যে,
بَابُ ذِكْرِ الدَّلِيلِ عَلَى أَنَّ الْخِدَاجَ الَّذِي أَعْلَمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي هَذَا الْخَبَرِ هُوَ النَّقْصُ الَّذِي لاَ تُجْزِئُ الصَّلاَةُ مَعَهُ، إِذِ النَّقْصُ فِي الصَّلاَةِ يَكُوْنُ نَقْصَيْنِ، أَحَدُهُمَا لاَ تُجْزِئُ الصَّلاَةُ مَعَ ذَلِكَ النَّقْصِ، وَالآخَرُ تَكُوْنُ الصَّلاَةُ جَائِزَةً مَعَ ذَلِكَ النَّقْصِ لاَ يَجِبُ إِعَادَتُهَا، وَلَيْسَ هَذَا النَّقْصُ مِمَّا يُوجِبُ سَجْدَتَيِ السَّهْوِ مَعَ جَوَازِ الصَّلاَةِ- (صحيح ابن خزيمة، كتاب الصلاة، باب ৯৫)-
‘ঐ ‘খিদাজ’-এর আলোচনা যে সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) অত্র হাদীছে হুঁশিয়ার করেছেন যে, ঐ ত্রুটি থাকলে ছালাত সিদ্ধ হবে না। কেননা ত্রুটি দু’প্রকারেরঃ এক- যা থাকলে ছালাত সিদ্ধ হয় না। দুই- যা থাকলেও ছালাত সিদ্ধ হয়। পুনরায় পড়তে হয় না। এই ত্রুটি হ’লে ‘সিজদায়ে সহো’ দিতে হয় না। অথচ ছালাত সিদ্ধ হয়ে যায়’।
অতঃপর তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) -এর হাদীছ উদ্ধৃত করেন যে, لاَ تُجْزِئُ صَلاَةٌ لاَ يُقْرَأُ ا فِيْهَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘ঐ ছালাত সিদ্ধ নয়, যাতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা হয় না’.....। [44]
এক্ষণে ‘লা ছালা-তা বা ‘ছালাত নয়’-এর অর্থ যখন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘লা তুজযিউ’ অর্থাৎ ‘ছালাত সিদ্ধ নয়’ বলে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তখন সেখানে আমাদের নিজস্ব ব্যাখ্যার কোন অবকাশ নেই। অতএব ‘খিদাজ’ অর্থ ‘অপূর্ণাঙ্গ’ করাটা অন্যায়। বরং এটি ‘ক্রটিপূর্ণ’। আর ত্রুটিপূর্ণ ছালাত প্রকৃত অর্থে কোন ছালাত নয়।
অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছহীহ হাদীছ, অধিকাংশ ছাহাবী ও তাবেঈন এবং ইমাম মালেক, শাফেঈ ও আহমাদ সহ অধিকাংশ মুজতাহিদ ইমামগণের সিদ্ধান্ত ও নিয়মিত আমলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সর্বাবস্থায় সকল ছালাতে সূরায়ে ফাতেহা পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য। নইলে অহেতুক যিদ কিংবা ব্যক্তি ও দলপূজার পরিণামে সারা জীবন ছালাত আদায় করেও ক্বিয়ামতের দিন স্রেফ আফসোস ব্যতীত কিছুই জুটবে না। যেমন আল্লাহ বলেন, যেদিন অনুসরণীয় ব্যক্তিগণ তাদের অনুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে ও সকলে আযাবকে প্রত্যক্ষ করবে এবং তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক সমূহ ছিন্ন হবে’। ‘যেদিন অনুসারীগণ বলবে, যদি আমাদের আরেকবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, যেমন আজ তারা আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এমনিভাবে আল্লাহ সেদিন তাদের সকল আমলকে তাদের জন্য ‘আফসোস’ হিসাবে দেখাবেন। অথচ তারা কখনোই জাহান্নাম থেকে বের হবে না’ (বাক্বারাহ ২/১৬৬-৬৭)।
৫. (গ) রুকূ পেলে রাক‘আত না পাওয়া (لا يدرك الركعة بإدراك الركوع فقط)
ক্বিয়াম ও ক্বিরাআতে ফাতেহা ব্যতীত কেবলমাত্র রুকূ পেলেই রাক‘আত পাওয়া হবে না। এমতাবস্থায় তাকে আরেক রাক‘আত যোগ করে পড়তে হবে। তবে জমহূর বিদ্বানগণের অভিমত হ’ল এই যে, রুকূ পেলে রাক‘আত পাবে। সূরায়ে ফাতেহা পড়তে পারুক বা না পারুক’। তাঁদের প্রধান দলীল সমূহ নিম্নরূপ :
(১) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,مَنْ أَدْرَكَ رَكْعَةً مِّنَ الصَّلاَةِ مَعَ الْإِمَامِ فَقَدْ أَدْرَكَ الصَّلاَةَ كُلَّهَا- ‘যে ব্যক্তি ইমামের সাথে ছালাতের এক রাক‘আত পেল, সে ব্যক্তি পূর্ণ ছালাত পেল’।[45]
জবাব : জমহূর বিদ্বানগণ এখানে ‘রাক‘আত’ অর্থ ‘রুকূ’ করেছেন। ইমাম বুখারী বলেন যে, এখানে রাক‘আত বলা হয়েছে। রুকূ, সিজদা বা তাশাহহুদ বলা হয়নি’ (অথচ সবগুলো মিলেই রাক‘আত হয়) (‘আওনুল মা‘বূদ ৩/১৫২)শামসুল হক আযীমাবাদী বলেন, ‘এখানে কোন কারণ ছাড়াই রাক‘আত অর্থ রুকূ করা হয়েছে যা ঠিক নয়’। যেমন ছহীহ মুসলিমে বারা বিন আযেব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে ‘ক্বিয়াম ও সিজদার বিপরীতে রাক‘আত শব্দ এসেছে। সেখানে রাক‘আত অর্থ রুকূ করা হয়েছে। [46] ‘আব্দুর রহমান সা‘দীও তাই বলেন’ (আল-মুখতারাত, পৃঃ ৪৪) ।
(২) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুম‘আর ছালাতের শেষ রাক‘আতে রুকূ পেল, সে যেন আরেক রাক‘আত যোগ করে নেয়। কিন্তু যে ব্যক্তি শেষ রাক‘আতে রুকূ পেল না, সে যেন যোহরের চার রাক‘আত পড়ে।[47]
জবাব : দারাকুৎনী বর্ণিত অত্র হাদীছটি ‘যঈফ’।[48]
(৩) আবু বাকরাহ (রাঃ) হ’তে একটি হাদীছ পেশ করা হয়ে থাকে। তিনি একাকী রুকূ অবস্থায় পিছন থেকে কাতারে প্রবেশ করেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন, আল্লাহ তোমার আগ্রহ বৃদ্ধি করুন। তবে আর কখনো এরূপ করো না’।[49]
জবাব : ইবনু হাযম আন্দালুসী ও ইমাম শাওকানী বলেন, এ হাদীছের মধ্যে জমহূরের মতের পক্ষে কোন দলীল নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ) তাকে যেমন ঐ রাক‘আত পুনরায় পড়তে বলেননি, তেমনি ঐ ছাহাবী ঐ রাক‘আতটি গণনা করেছিলেন কি-না, সেকথাও বর্ণিত হয়নি।[50]
অন্যান্য বিদ্বানগণ জমহূরের মতের বিরোধিতা করেন এবং বলেন যে, শুধুমাত্র রুকূ পেলেই রাক‘আত পাওয়া হবে না। কেননা সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা ফরয। যা পরিত্যাগ করলে ছালাত বাতিল হবে ও পুনরায় পড়তে হবে।[51] যেমন ক্বিয়াম, রুকূ, সিজদা ইত্যাদি ফরয, যার কোন একটি বাদ দিলে ছালাত বাতিল হবে ও পুনরায় নতুনভাবে পড়তে হবে।
এক্ষণে যে ব্যক্তি কেবল রুকূ পেল, সে ব্যক্তি ক্বিয়াম ও ক্বিরাআতে ফাতেহার দু’টি ফরয তরক করল। অতএব তার ঐ রাক‘আত গণ্য হবে না। বরং তাকে আরেক রাক‘আত যোগ করে পড়তে হবে। অবশ্য ছালাতে যোগদান করার নেকী তিনি পুরোপুরি পেয়ে যাবেন। এঁদের দলীল সমূহ নিম্নরূপ:
(১) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, فَمَا أَدْرَكْتُمْ فَصَلُّوْا وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوْا- ‘ইক্বামত শুনে তোমরা দৌড়ে যেয়ো না। বরং স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাও। তোমাদের জন্য স্থিরতা অবলম্বন করা আবশ্যক। অতঃপর তোমরা জামা‘আতে ছালাতের যতটুকু পাও, ততটুকু আদায় কর এবং যেটুকু ছুটে যায় সেটুকু পূর্ণ কর’।[52] ইমাম বুখারী বলেন, এখানে ঐ ব্যক্তি কেবল রুকূ পেয়েছে। কিন্তু ক্বিয়াম ও ক্বিরাআতে ফাতেহার দু’টি ফরয পায়নি। অতএব তাকে শেষে এক রাক‘আত যোগ করে ঐ ছুটে যাওয়া ফরয দু’টি পূর্ণ করতে হবে’। [53]
(২) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক একটি ‘মওকূফ’ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, لاَ يُجْزِئُكَ إِلاَّ أَنْ تُدْرِكَ الْإِمَامَ قَائِمًا ‘তোমার জন্য যথেষ্ট হবে না যদি না তুমি ইমামকে দাঁড়ানো অবস্থায় পাও’।[54] হাফেয ইবনু হাজার বলেন, আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রুকূ পেলে রাক‘আত না পাওয়ার বিষয়টিই প্রসিদ্ধ।[55]
(৩) তাবেঈ বিদ্বান মুজাহিদ বলেন, সূরায়ে ফাতিহা পড়তে ভুলে গেলে সে রাক‘আত গণনা করা হ’ত না (لاَ تُعَدُّ تِلْكَ الرَّكْعَةُ)। [56]
ইবনু হাযম বলেন, রাক‘আত পূর্ণ হওয়ার জন্য তার উপরে অবশ্য করণীয় হ’ল ক্বিয়াম ও ক্বিরাআত করা। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, রাক‘আত ও অন্য কোন রুকন ছুটে যাওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ফলে ইমামের সাথে যোগদানের সময় কোন রাক‘আত ছুটে গেলে তা যেমন পরে আদায় করতে হয়, অনুরূপভাবে সূরায়ে ফাতিহা ছুটে গেলে সেটাও পরে আদায় করতে হবে। কেননা ওটাও অন্যতম রুকন, যা আদায় করা ফরয। এক্ষণে ‘সূরায়ে ফাতিহা ছুটে গেলেও ছালাত হয়ে যাবে’ বলে যদি দাবী করা হয়, তবে তার জন্য স্পষ্ট ও ছহীহ দলীল প্রয়োজন হবে। অথচ তা পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, কেউ কেউ আগ বেড়ে এ বিষয়ে ইজমা-এর দাবী করেছেন। ঐ ব্যক্তি ঐ বিষয়ে মিথ্যাবাদী। কেননা আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সূরায়ে ফাতিহা পড়তে না পারলে ঐ রাক‘আত গণনা করতেন না’। অমনিভাব যায়েদ বিন ওয়াহাব থেকেও বর্ণিত হয়েছে। [57]
ইমাম শাওকানী বলেন, ইমাম ও মুক্তাদী সকলের জন্য সর্বাবস্থায় প্রতি রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা ‘ফরয’। বরং এটি ছালাত সিদ্ধ হওয়ার অন্যতম শর্ত। অতএব যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, এটা ছাড়াই ছালাত সিদ্ধ হবে, তাকে এমন স্পষ্ট দলীল পেশ করতে হবে, যা পূর্বে বর্ণিত না সূচক ‘আম’ দলীলগুলিকে ‘খাছ’ করতে পারে’। [58]
উপসংহার : উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, শুধুমাত্র রুকূ পেলে রাক‘আত হবেনা। বরং তাকে আরেক রাক‘আত যোগ করে পড়তে হবে। এটা বলা যেতে পারে যে, যেখানে রুকূ পেলে রাক‘আত পাওয়ার স্পষ্ট দলীল নেই এবং যেখানে আরেক রাক‘আত যোগ করার ব্যাপারে ছাহাবী ও তাবেঈগণের স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে, সেখানে অন্য কারো বক্তব্য তালাশ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। এরপরেও ইমাম বুখারী, ইমাম ইবনু হাযম, ইমাম শাওকানী ও তাঁদের সমমনা বিদ্বানগণকে বাদ দিলে জমহূর বিদ্বানগণ বলতে আর কাদের বুঝানো হবে, সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়।
ক্বিরাআতের আদব (آداب القراءة)
(১) সূরায়ে ফাতিহার প্রতিটি আয়াতের শেষে ওয়াকফ করা সুন্নাত।[59] অমনিভাবে ক্বিরাআত সুন্দর আওয়াযে পড়ার নির্দেশ রয়েছে।[60] কিন্তু গানের সুরে পড়া যাবে না।[61] কোনরূপ ‘তাকাল্লুফ’ বা ভান করা যারে না। বরং স্বাভাবিক সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করাই শরী‘আতে পসন্দনীয়। ‘ছানা’ পড়ার জন্য ক্বিরাআতের শুরুতে ‘সাকতা’ করা অর্থাৎ সামান্য বিরতি দেওয়া সুন্নাত।[62] ১ম রাক‘আতের ক্বিরাআত কিছুটা দীর্ঘ হওয়া বাঞ্ছনীয়। [63] অমনিভাবে কুরআনের শুরুর দিক থেকে শেষের দিকে ক্বিরাআত করা ভাল। তবে আগপিছ হ’লে দোষ নেই। এমনকি একই সূরা পরপর দুই রাক‘আতে পড়া চলে।[64]
(২) জেহরী ছালাতে প্রথম দু’রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠের পর ইমাম হ’লে যেকোন সূরা পাঠ করবে। আর মুক্তাদী হ’লে সূরা ফাতিহা পড়ার পর [65] আর কিছুই না পড়ে কেবল ইমামের ক্বিরাআত মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তবে যোহর ও আছরের ছালাতে ইমাম-মুক্তাদী সকলে সূরায়ে ফাতিহা সহ অন্য সূরা পড়বে এবং ৩য় ও ৪র্থ রাক‘আতে কেবল সূরায়ে ফাতিহা পড়বে। যেমন আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে,
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ فِي الظُّهْرِ فِي الْأُوْلَيَيْنِ بِأُمِّ الْكِتَابِ وَ سُوْرَتَيْنِ وَ فِي الرَّكْعَتَيْنِ الْأُخْرَيَيْنِ بِأُمِّ الْكِتَابِ ... وَهَكَذَا فِي الْعَصْرِ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যোহরের প্রথম দু’রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা ও অন্য দু’টি সূরা পড়তেন এবং শেষের দু’রাক‘আতে কেবল সূরায়ে ফাতিহা পড়তেন। ... অনুরূপ করতেন আছরে ...’।[66] শেষের দু’রাক‘আতেও কোন কোন ছাহাবী সূরা মিলাতেন বলে জানা যায়।[67]
(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকল ছালাতে সময় ও সুযোগ মত ক্বিরাআত দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত করতেন। তিনি (ক) ফজরের ১ম রাক‘আতে অধিকাংশ সময় ক্বিরাআত দীর্ঘ করতেন এবং ‘ক্বাফ’ হ’তে ‘মুরসালাত’ পর্যন্ত ‘দীর্ঘ বিস্তৃত’ (طوال المفصَّل) সূরা সমূহ হ’তে পাঠ করতেন। কখনো ‘নাবা’ হ’তে ‘লাইল’ পর্যন্ত ‘মধ্যম বিস্তৃত’ (أوساط المفصَّل) সূরা সমূহ হ’তে এবং কখনো ‘যোহা’ হ’তে ‘নাস’ পর্যন্ত ‘স্বল্প বিস্তৃত’ (قصار المفصَّل) সূরা সমূহ হ’তে পাঠ করতেন [68] (খ) তিনি যোহর ও আছরের প্রথম দু’রাক‘আত দীর্ঘ করতেন এবং শেষের দু’রাক‘আত সংক্ষেপ করতেন। তিনি মাগরিবের ছালাতে ‘স্বল্প বিস্তৃত’ সূরা সমূহ হ’তে, এশার ছালাতে ‘মধ্যম বিস্তৃত’ সূরা সমূহ হ’তে এবং ফজরের ছালাতে ‘দীর্ঘ বিস্তৃত’ সূরা সমূহ হ’তে পাঠ করতেন। কখনো এর বিপরীত করতেন। (গ) কখনো তিনি একই রাক‘আতে পরপর দু’টি বা ততোধিক সূরা পড়েছেন (ঘ) কখনো একই সূরা পরপর দু’রাক‘আতে পড়েছেন (ঙ) তিনি ফজরের দু’রাক‘আতে কখনো সূরা কাফেরূণ ও ইখলাছ এবং কখনো ফালাক্ব ও নাস পাঠ করেছেন (চ) ১ম রাক‘আতে তিনি ক্বিরাআত দীর্ঘ এবং ২য় রাক‘আতে সংক্ষেপ করতেন। তবে কখনো কখনো ব্যতিক্রম হ’ত (ছ) তিনি ছালাতের প্রতি ক্বিরাআতের শুরুতে সূরা ইখলাছ পাঠকারীর প্রশংসা করেছেন (জ) তিনি তিন দিনের কমে কুরআন খতম করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন যে, এর কমে হ’লে সে কুরআনের কিছুই বুঝবে না (ঝ) তাঁর রাক‘আত, ক্বিরাআত ও সিজদা সর্বদা প্রথম থেকে শেষের দিকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত হ’ত। [69]
৬. সশব্দে আমীন (آمين بالجهر)
জেহরী ছালাতে ইমামের সূরায়ে ফাতিহা পাঠ শেষে ইমাম-মুক্তাদী সকলে সরবে ‘আমীন’ বলবে। ইমামের আগে নয় বরং ইমামের ‘আমীন’ বলার সাথে সাথে মুক্তাদীর ‘আমীন’ বলা ভাল। তাতে ইমামের পিছে পিছে মুক্তাদীর সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা সম্ভব হয় এবং ইমাম, মুক্তাদী ও ফেরেশতাদের ‘আমীন’ সম্মিলিতভাবে হয়। যেমন এরশাদ হয়েছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا أَمَّنَ الْإِمَامُ فَأَمِّنُوْا... وَفِي رِوَايَةٍ : إِذَا قَالَ الْإِمَامُ وَلاَ الضَّالِّيْنَ فَقُوْلُوْا آمِيْنَ، فَإِنَّ الْمَلآئِكَةَ تَقُوْلُ آمِيْنَ وَإِنَّ الْإِمَامَ يَقُوْلُ آمِيْنَ، فَمَنْ وَافَقَ تَأْمِيْنُهُ تَأْمِيْنَ الْمَلآئِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ رواه الجماعةُ وأحمدُ- وَفِيْ رِوَايَةٍ عنه: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا قَالَ أَحَدُكُمْ آمِيْنَ وَقَالَتِ الْمَلآئِكَةُ فِي السَّمَاءِ آمِيْنَ، فَوَافَقَتْ إِحْدَاهُمَا الْأُخْرَى، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، رواه الشيخانُ ومالكُ- وعن وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَرَأَ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّآلِّيْنَ فَقَالَ آمِيْنَ، وَمَدَّ بِهَا صَوْتَهُ، رواه أبو داؤدَ والترمذىُّ وابنُ ماجه-
কুতুবে সিত্তাহ সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীছগুলির সারকথা হ’ল এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, যখন ইমাম ‘আমীন’ বলে কিংবা ‘ওয়ালায্ যা-ল্লীন’ পাঠ শেষ করে, তখন তোমরা সকলে ‘আমীন’ বল। কেননা যার ‘আমীন’ আসমানে ফেরেশতাদের ‘আমীন’-এর সাথে মিলে যাবে, তার পূর্বেকার সকল গুনাহ মাফ করা হবে’। [70] ওয়ায়েল বিন হুজ্র (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘গায়রিল মাগযূবে ‘আলাইহিম ওয়ালায্ যা-ল্লীন’ বলার পরে তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে আমীন বলতে শুনলাম’। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে। [71]
‘আমীন’ অর্থ : اَللَّهُمَّ اسْتَجِبْ ‘হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর’। ‘আমীন’ (آمِيْن)-এর আলিফ -এর উপরে ‘মাদ্দ’ বা ‘খাড়া যবর’ দুটিই পড়া জায়েয আছে। [72] নাফে‘ বলেন, ইবনু ওমর (রাঃ) কখনো ‘আমীন’ বলা ছাড়তেন না এবং তিনি এব্যাপারে সবাইকে উৎসাহ দিতেন’। আত্বা বলেন, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) সরবে ‘আমীন’ বলতেন। তাঁর সাথে মুক্তাদীদের ‘আমীন’-এর আওয়াযে মসজিদ গুঞ্জরিত হয়ে উঠত’ (حَتَّى إِنَّ لِلْمَسْجِدِ لَلَجَّةً)।[73]
এক্ষণে যদি কোন ইমাম ‘আমীন’ না বলেন, কিংবা নীরবে বলেন, তবুও মুক্তাদী সরবে ‘আমীন’ বলবেন।[74] অনুরূপভাবে যদি কেউ জেহরী ছালাতে ‘আমীন’ বলার সময় জামা‘আতে যোগদান করেন, তবে তিনি প্রথমে সরবে ‘আমীন’ বলে নিবেন ও পরে নীরবে সূরায়ে ফাতিহা পড়বেন। ইমাম ঐ সময় পরবর্তী ক্বিরাআত শুরু করা থেকে কিছু সময় বিরতি দিবেন। যাতে সূরা ফাতিহা ও পরবর্তী আমীন ও ক্বিরাআতের মধ্যে পার্থক্য বুঝা যায়। উল্লেখ্য যে, এ সময় মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ করা এবং সেই সময় পরিমাণ ইমামের চুপ থাকার কোন দলীল নেই।[75] ‘আমীন’ শুনে কারু গোস্বা হওয়া উচিত নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,
عَنْ عَائِشَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَا حَسَدَتْكُمُ الْيَهُوْدُ عَلَى شَيْءٍ مَا حَسَدَتْكُمْ عَلَى السَّلاَمِ وَالتَّأْمِيْنِ، رواه أحمد وإبن ماجه والطبراني- وفي رواية عنها بلفظ: مَا حَسَدَتْكُمُ الْيَهُوْدُ عَلَى شَيْءٍ مَا حَسَدَتْكُمْ عَلَى قَوْلِ آمِيْنَ-
‘ইহুদীরা তোমাদের সবচেয়ে বেশী হিংসা করে তোমাদের ‘সালাম’ ও ‘আমীন’ -এর কারণে’। [76] কারণ এই সাথে ফেরেশতারাও ‘আমীন’ বলেন। ফলে তা আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়।
উল্লেখ্য যে, ‘আমীন’ বলার পক্ষে ১৭টি হাদীছ এসেছে।[77] যার মধ্যে ‘আমীন’ আস্তে বলার পক্ষে শো‘বা থেকে একটি রেওয়ায়াত আহমাদ ও দারাকুৎনীতে এসেছে أو أَخْفَي بِهَا صَوْتَهُ خَفَضَ বলে। যার অর্থ ‘আমীন’ বলার সময় রাসূল (ছাঃ)-এর আওয়ায নিম্নস্বরে হ’ত’। একই রেওয়ায়াত সুফিয়ান ছাওরী থেকে এসেছে رَفَعَ بِهَا صَوْتَهُ বলে। যার অর্থ- ‘তাঁর আওয়ায উচ্চৈঃস্বরে হ’ত’। হাদীছ বিশারদ পন্ডিতগণের নিকটে শো‘বা থেকে বর্ণিত নিম্নস্বরে ‘আমীন’ বলার হাদীছটি ‘মুযত্বারিব’ (مضطرب)। অর্থাৎ যার সনদ ও মতনে নাম ও শব্দগত ভুল থাকার কারণে ‘যঈফ’। পক্ষান্তরে সুফিয়ান ছওরী (রাঃ) বর্ণিত সরবে আমীন বলার হাদীছটি এসব ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়ার কারণে ‘ছহীহ’।[78] অতএব বুখারী ও মুসলিম সহ বিভিন্ন ছহীহ হাদীছে বর্ণিত জেহরী ছালাতে সশব্দে ‘আমীন’ বলার বিশুদ্ধ সুন্নাতের উপরে আমল করাই নিরপেক্ষ মুমিনের কর্তব্য। তাছাড়া ইমামের সশব্দে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ শেষে ‘ছিরাতুল মুস্তাক্বীম’-এর হেদায়াত প্রার্থনার সাথে মুক্তাদীগণের নীরবে সমর্থন দান কিছুটা বিসদৃশ বৈ-কি!
৭. রুকূ (الركوع)
‘রুকূ’ অর্থ ‘মাথা ঝুঁকানো’ (الإنحناء)। পারিভাষিক অর্থ, শারঈ তরীকায় আল্লাহর সম্মুখে মাথা ঝুঁকানো’। ক্বিরাআত শেষে মহাপ্রভু আল্লাহর সম্মুখে সশ্রদ্ধচিত্তে মাথা ও পিঠ ঝুঁকিয়ে রুকূতে যেতে হয়। রুকূতে যাওয়ার সময় ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে তাকবীরের সাথে দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত সোজাভাবে উঠাবে। অতঃপর দুই হাতের আঙ্গুল খোলা রেখে দুই হাঁটুর উপরে ভর দিয়ে রুকূ করবে। রুকূর সময় পিঠ ও মাথা সোজা ও সমান্তরাল রাখবে। হাঁটু ও কনুই সোজা থাকবে। অতঃপর সিজদার স্থান বরাবর নযর স্থির রেখে[79] সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা ও নিজের ক্ষমা প্রার্থনায় মনোনিবেশ করে দো‘আ পড়তে থাকবে। রুকূ ও সিজদার জন্য হাদীছে অনেকগুলি দো‘আ এসেছে। তন্মধ্যে রুকূর জন্য سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيْمِ (সুবহা-না রবিবয়াল ‘আযীম) ‘মহা পবিত্র আমার প্রতিপালক যিনি মহান’ এবং সিজদার জন্য سُبْحَانَ رَبِّىَ الْأَعْلَى ( সুবহা-না রবিবয়াল আ‘লা) ‘মহা পবিত্র আমার প্রতিপালক যিনি সর্বোচ্চ’[80] সর্বাধিক প্রচলিত। এ দু’টি দো‘আ তিনবার পড়বে। বেশির কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট নেই। [81] ঊর্ধ্বে দশবার পড়ার হাদীছ ‘যঈফ’।[82] তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জীবনের শেষদিকে এসে রুকূ ও সিজদাতে এমনকি ছালাতের বাইরে অধিকাংশ সময় নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়তেন।-
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنا وَبِحَمْدِكَ، اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لِيْ- (সুবহ-নাকা আল্লা-হুম্মা রববানা ওয়া বিহাম্দিকা, আল্লা-হুম্মাগ্ফিরলী) ‘হে আল্লাহ হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার প্রশংসার সাথে আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন! [83]
এতদ্ব্যতীত নিম্নে রুকূর অন্যান্য দো‘আ সমূহ একত্রে একই সময়ে কিংবা পৃথকভাবে বিভিন্ন সময়ে পড়া যায়। যেমন-
1- سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيْمِ وَبِحَمْدِهِ- ثَلاَثًا- (أبو داؤد وغيره)-
2- سُبُّوْحٌ قُدُّوْسٌ رَبُّ الْمَلاَئِكَةِ وَالرُّوْحِ (مسلم وغيره)-
3- اَللَّهُمَّ لَكَ رَكَعْتُ، وَبِكَ آمَنْتُ، وَلَكَ أَسْلَمْتُ، خَشَعَ لَكَ سَمْعِيْ وَبَصَرِيْ وَمُخِّيْ وَعَظْمِيْ وَعَصَبِيْ- (مسلم وغيره)-
4- اَللَّهُمَّ لَكَ رَكَعْتُ وَبِكَ أَسْلَمْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ، اَنْتَ رَبِّى خَشَعَ سَمْعِىْ وَبَصَرِىْ وَدَمِىْ وَلَحْمِىْ وَعَظْمِىْ وَعَصَبِىْ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ- (نسائى)-
5- سُبْحَانَ ذِي الْجَبَرُوْتِ وَالْمَلَكُوْتِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْعَظْمَةِ- وهذا قاله النبى r فى صلاة الليل- (أبو داؤد والنسائى)، صفة صلاة النبى r للألبانى صـ113-114-
৮. ক্বওমা (القومة)
রুকূ থেকে উঠে সুস্থির হয়ে দাঁড়ানোকে ‘ক্বওমা’ বলে। ‘ক্বওমা’র সময় দু’হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে ও ইমাম-মুক্তাদী সকলে বলবে, سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ(সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ) অর্থাৎ ‘আল্লাহ শোনেন তার কথা যে তাঁর প্রশংসা করে’। অতঃপর বলবে رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ (রববানা ওয়া লাকাল হাম্দ) অথবা رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ (রববানা লাকাল হাম্দ) অথবা (اَللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ) (আল্লা-হুম্মা রববানা লাকাল হাম্দ) ‘হে আল্লাহ হে আমাদের প্রভু! আপনার জন্যই যাবতীয় প্রশংসা’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যার কথা ফেরেশতাদের কথার সঙ্গে মিলে যাবে তার বিগত দিনের সকল গোনাহ মাফ করা হবে।[84] অথবা বলবে, رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُّبَارَكًا فِيْهِ (রববানা ওয়া লাকাল হাম্দ হাম্দান কাছীরান ত্বাইয়েবাম মুবা-রাকান ফীহি) ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার জন্য অগণিত প্রশংসা, যা পবিত্র ও বরকতময়’। দো‘আটির ফযীলত বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘আমি ৩০-এর অধিক ফেরেশতাকে দেখলাম যে, তারা প্রতিযোগিতা করছে কে এই দো‘আ পাঠকারীর নেকী আগে লিখবে’।[85]
ক্বওমার অন্যান্য দো‘আ সমূহ :
1- رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُّبَارَكًا فِيْهِ كَمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى- (مالك والبخاري وابوداؤد)-
2- اَللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ مِلْءَ السَّمَاوَاتِ وَمِلْءَ الْأَرْضِ وَمِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَيْءٍ بَعْدُ- (مسلم، صفة صلاة النبى r 117-119)-
উল্লেখ্য যে, ‘ইয়া রববী লাকাল হামদু কামা ইয়াম্বাগী লিজালা-লি ওয়াজহিকা ওয়া লি ‘আযীমি সুলত্বা-নিকা’ বলে এই সময়ে যে দো‘আ প্রচলিত আছে, তার সনদ যঈফ। [86]
ক্বওমাতে রুকূর ন্যায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দো‘আ পড়তে হয়। কেননা ‘ক্বওমার সময় সুস্থির হয়ে না দাঁড়ালে এবং সিজদা থেকে উঠে সুস্থির ভাবে না বসলে ছালাত সিদ্ধ হবে না।[87] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
لاَ تُجْزِئُ صَلاَةُ الرَّجُلِ حَتَّى يُقِيْمَ ظَهْرَهُ فِي الرُّكُوْعِ وَالسُّجُوْدِ-
‘ঐ ব্যক্তির ছালাত যথার্থ হবে না, যতক্ষণ না সে রুকূ ও সিজদাতে তার পিঠ সোজা রাখে’।[88]
জ্ঞাতব্য : ক্বওমার সময় অনেকে হাত কিছুক্ষণ খাড়াভাবে ধরে রাখেন। কেউ পুনরায় বুকে হাত বাঁধেন। যা ঠিক নয়। এ বিষয়ে ছহীহ হাদীছ সমূহ নিম্নরূপ :
(১) বিখ্যাত ছাহাবী আবু হুমায়েদ সা‘এদী (রাঃ) যিনি ১০ জন ছাহাবীর সম্মুখে রাসূলের (ছাঃ) ছালাতের নমুনা প্রদর্শন করে সত্যায়ন প্রাপ্ত হয়েছিলেন, সেখানে বলা হয়েছে-
فَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ اسْتَوَى حَتَّى يَعُوْدَ كُلُّ فَقَارٍ مَكَانَهُ، رواه البخاريُّ-
‘তিনি রুকূ থেকে মাথা উঠিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন এমনভাবে যে, মেরুদন্ডের জোড় সমূহ স্ব স্ব স্থানে ফিরে আসে’। [89]
(২) ছালাতে ভুলকারী (مسيئ الصلاة) জনৈক ব্যক্তিকে রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক হাতে-কলমে ছালাত শিখানোর প্রসিদ্ধ হাদীছে এসেছে حَتَّى تَرْجِعَ الْعِظَامُ إِلَى مَفَاصِلِهَا ‘যতক্ষণ না অস্থি সমূহ স্ব স্ব জোড়ে ফিরে আসে’।[90] ওয়ায়েল বিন হুজ্র ও সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বর্ণিত ‘ছালাতে বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখার ‘আম’ হাদীছের[91] উপরে ভিত্তি করে রুকূর আগে ও পরে ক্বওমা-র সময় বুকে হাত বাঁধার কথা বলা হয়।[92] কিন্তু উপরোক্ত হাদীছগুলি রুকূ পরবর্তী ‘ক্বওমা’র অবস্থা সম্পর্কে ‘খাছ’ ভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া বুকে হাত বাঁধার বিষয়টি হাতের স্বাভাবিক অবস্থার পরিপন্থী। এক্ষণে শিরদাঁড়া সহ দেহের অন্যান্য অস্থি সমূহকে স্ব স্ব জোড়ে ফিরে আসতে গেলে ক্বওমার সময় হাতকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দেওয়াটাই ছহীহ হাদীছ সমূহের যথাযথ অনুসরণ বলে অনুমিত হয়। [93] আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
৯. রাফ‘উল ইয়াদায়েন (رفع اليدين)
এর অর্থ- দু’হাত উঁচু করা। এটি আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণের অন্যতম নিদর্শন।[94] রুকূ থেকে উঠে ক্বওমাতে দাঁড়িয়ে দু’হাত ক্বিবলামুখী স্বাভাবিকভাবে কাঁধ বা কান বরাবর উঁচু করে তিন বা চার রাক‘আত বিশিষ্ট ছালাতে মোট চারস্থানে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করতে হয়। (১) তাকবীরে তাহরীমার সময় (২) রুকূতে যাওয়ার সময় (৩) রুকূ থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াবার সময় এবং (৪) ৩য় রাক‘আতে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বাঁধার সময়। এমনিভাবে প্রতি তাশাহ্হুদের বৈঠকের পর উঠে দাঁড়াবার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতে হয়।
রুকূতে যাওয়া ও রুকূ হ’তে ওঠার সময় ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করা সম্পর্কে চার খলীফা সহ প্রায় ২৫ জন ছাহাবী থেকে বর্ণিত ছহীহ হাদীছ সমূহ রয়েছে। একটি হিসাব মতে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’-এর হাদীছের রাবী সংখ্যা ‘আশারায়ে মুবাশ্শারাহ’[95] সহ অন্যূন ৫০ জন ছাহাবী[96] এবং সর্বমোট ছহীহ হাদীছ ও আছারের সংখ্যা অন্যূন চার শত। [97] ইমাম সুয়ূত্বী ও আলবানী প্রমুখ বিদ্বানগণ ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ -এর হাদীছকে ‘মুতাওয়াতির’ (যা ব্যাপকভাবে ও অবিরত ধারায় বর্ণিত) পর্যায়ের বলে মন্তব্য করেছেন।[98] ইমাম বুখারী বলেন,
لَمْ يَثْبُتْ عَنْ أَحَدٍ مِّنْهُمْ تَرْكُهُ. و قَالَ : لاَ أَسَانِيْدَ أَصَحُّ مِنْ أَسَانِيْدِ الرَّفْعِ-
অর্থাৎ কোন ছাহাবী রাফ‘উল ইয়াদায়েন তরক করেছেন বলে প্রমাণিত হয়নি। তিনি আরও বলেন ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’-এর হাদীছ সমূহের সনদের চেয়ে বিশুদ্ধতম সনদ আর নেই’। [99] রাফ‘উল ইয়াদায়েন সম্পর্কে প্রসিদ্ধতম হাদীছ সমূহের কয়েকটি নিম্নরূপঃ
(১) আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ حَذْوَ مَنْكَبَيْهِ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلاَةَ وَإِذَا كَبَّرَ لِلرُّكُوْعِ وَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرُّكُوْعِ... مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ، وفي رِوَايةٍ عنه: وَ إِذَا قَامَ مِنَ الرَّكْعَتَيْنِ رَفَعَ يَدَيْهِ.... رواه البخاريُّ-
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাতের শুরুতে, রুকূতে যাওয়াকালীন ও রুকূ হ’তে ওঠাকালীন সময়ে..... এবং ২য় রাক‘আত থেকে উঠে দাঁড়াবার সময় ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করতেন’। [100] হাদীছটি বায়হাক্বীতে বর্ধিতভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, فََمَا زَالَتْ تِلْكَ صَلاَتُهُ حَتَّي لَقِيَ اللهَ تَعَالَي- ‘এভাবেই তাঁর ছালাত জারি ছিল, যতদিন না তিনি আল্লাহর সাথে মিলিত হন’। অর্থাৎ আমৃত্যু তিনি রাফ‘উল ইয়াদায়েন সহ ছালাত আদায় করেছেন। ইমাম বুখারীর উস্তাদ আলী ইবনুল মাদীনী বলেন, এই হাদীছ আমার নিকটে সমস্ত উম্মতের উপরে ‘হুজ্জাত’ বা দলীল স্বরূপ (حُجَّةٌ عَلَي الْخَلْقِ)। যে ব্যক্তি এটা শুনবে, তার উপরেই এটা আমল করা কর্তব্য হবে। হাসান বছরী ও হামীদ বিন হেলাল বলেন, সকল ছাহাবী উক্ত তিন স্থানে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন’। [101]
(২) মালিক ইবনুল হুওয়াইরিছ (রাঃ) বলেন,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا كَبَّرَ رَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى يُحَاذِيَ بِهِمَا أُذُنَيْهِ، وَإِذَا رَكَعَ رَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى يُحَاذِيَ بِهِمَا أُذُنَيْهِ، وَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرُّكُوْعِ فَقَالَ سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ فَعَلَ مِثْلَ ذَلِكَ، رواه مسلمٌ-
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ছালাতের জন্য ‘তাকবীরে তাহরীমা’ দিতেন, তখন হাত দু’টি স্বীয় দুই কান পর্যন্ত উঠাতেন। অতঃপর রুকূতে যাওয়ার সময় ও রুকূ হ’তে উঠার সময় তিনি অনুরূপ করতেন এবং ‘সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ’ বলতেন’।[102]
উল্লেখ্য যে, শত শত ছহীহ হাদীছের বিপরীতে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত বাকী সময়ে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ না করার পক্ষে প্রধানতঃ যে চারটি হাদীছ পেশ করা হয়ে থাকে, তার সবগুলিই ‘যঈফ’। তন্মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। যেমন আলক্বামা বলেন যে, একদা ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) আমাদেরকে বলেন,
أَلاَ أُصَلِّيْ بِكُمْ صَلاَةَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَصَلَّى وَلَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ إِلاَّ مَرَّةً وَاحِدَةً مَعَ تَكْبِيْرَةِ الْاِفْتِتَاحِ، رواه الترمذىُّ وابوداؤدَ-
‘আমি কি তোমাদের নিকটে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত আদায় করব না? এই বলে তিনি ছালাত আদায় করেন। কিন্তু তাকবীরে তাহরীমার সময় একবার ব্যতীত অন্য সময় আর রাফ‘উল ইয়াদায়েন করলেন না’।[103] উক্ত হাদীছ সম্পর্কে ইবনু হিববান বলেন,
هَذَا أَحْسَنُ خَبَرٍ رَوَى أَهْلُ الْكُوْفَةِ فِي نَفْيِ رَفْعِ الْيَدَيْنِ فِي الصَّلاَةِ عِنْدَ الرُّكُوْعِ وَعِنْدَ الرَّفْعِ مِنْهُ، وَهُوَ فِي الْحَقِيْقَةِ أَضْعَفُ شَيْءٍ يُعَوَّلُ عَلَيْهِ، لِأَنَّ لَهُ عِلَلاً تُبْطِلُهُ-
‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ না করার পক্ষে কূফাবাসীদের এটিই সবচেয়ে বড় দলীল হ’লেও এটিই সবচেয়ে দুর্বলতম দলীল, যার উপরে নির্ভর করা হয়েছে। কেননা এর মধ্যে এমন সব বিষয় রয়েছে, যা একে বাতিল গণ্য করে’।[104]
শায়খ আলবানী বলেন, হাদীছটিকে ছহীহ মেনে নিলেও তা ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ -এর পক্ষে বর্ণিত ছহীহ হাদীছ সমূহের বিপরীতে পেশ করা যাবে না। কেননা لأنه نافٍ وتلك مُثْبِتَةٌ ومن المقرَّر في علم الأصول أن المثبتَ مقدَّمٌ علي النافي- ‘এটি না-বোধক এবং ঐগুলি হাঁ-বোধক। ইলমে হাদীছ-এর মূলনীতি অনুযায়ী হাঁ-বোধক হাদীছ না-বোধক হাদীছের উপর অগ্রাধিকার যোগ্য’।[105]
শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী বলেন,وَالَّذِيْ يَرْفَعُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّنْ لاَّ يَرْفَعُ ، فَإِنَّ أَحَادِيْثَ الرَّفْعِ أَكْثَرُ وَأَثْبَتُ- ‘যে মুছল্লী রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে, ঐ মুছল্লী আমার নিকট অধিক প্রিয় ঐ মুছল্লীর চাইতে, যে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে না। কেননা রাফ‘উল ইয়াদায়েন-এর হাদীছ সংখ্যায় বেশী ও অধিকতর মযবুত’।[106]
রাফ‘উল ইয়াদায়নের ফযীলত (فضل رفع اليدين ) :
রাফ‘উল ইয়াদায়েন হ’ল আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের অন্যতম নিদর্শন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন হ’ল ছালাতের সৌন্দর্য (رفع اليدين من زينة الصلاة)।’ রুকূতে যাওয়ার সময় ও রুকূ হ’তে ওঠার সময় কেউ রাফ‘উল ইয়াদায়েন না করলে তিনি তাকে ছোট পাথর ছুঁড়ে মারতেন।[107] উক্ববাহ বিন ‘আমের (রাঃ) বলেন, প্রত্যেক রাফ‘উল ইয়াদায়েন-এ ১০টি করে নেকী আছে। [108] যদি কেউ রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের মহববতে একটি নেকীর কাজ করেন, আল্লাহ বলেন, আমি তার নেকী ১০ থেকে ৭০০ গুণে বর্ধিত করি।[109] শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) বলেন, ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ হ’ল فعل تعظيمي বা সম্মান সূচক কম,র্ যা মুছল্লীকে আল্লাহর দিকে রুজু হওয়ার ব্যাপারে ও ছালাতে তন্ময় হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেয়’। [110]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিজদা থেকে উঠে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন না’।[111] ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন, ইমাম আহমাদ -এর অধিকাংশ বর্ণনাও একথা প্রমাণ করে যে, তিনি সিজদাকালে রাফ‘উল ইয়াদায়েন -এর সর্মথক ছিলেন না’।[112] শায়খ আলবানী সিজদায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কখনো কখনো রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন বলে যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন,[113] তার অর্থ রুকূর ন্যায় রাফ‘উল ইয়াদায়েন নয়। বরং সাধারণভাবে সিজদা থেকে হাত উঠানো বুঝানো হয়েছে বলে অনুমিত হয়। ইমাম আহমাদ বলেন, রাসূল (ছাঃ) দুই সিজদার মাঝে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন না’।[114]
রুকূ-সিজদার আদব (آداب الركوع والسجود) : বারা’ বিন আযেব (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রুকূ, সিজদা, দুই সিজদার মধ্যকার বৈঠক এবং রুকূ পরবর্তী ক্বওমা-র স্থিতিকাল প্রায় সমান হ’ত। [115] আনাস (রাঃ) বলেন, এগুলি এত দীর্ঘ হ’ত যে, মুক্তাদীগণের কেউ কেউ ধারণা করত যে, রাসূল )ছাঃ) হয়তোবা ছালাতের কথা ভুলে গেছেন’।[116]
১০. সিজদা (السجدة)
‘সিজদা’ অর্থ চেহারা মাটিতে রাখা (وضع الجبهة على الأرض) পারিভাষিক অর্থ, আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে বিনম্রচিত্তে চেহারা মাটিতে রাখা’। রুকূ হ’তে উঠে ক্বওমার দো‘আ শেষে ‘আল্লা-হু আকবর’ বলে আল্লাহর নিকটে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে এবং সিজদার দো‘আ সমূহ পাঠ করবে। নাক সহ কপাল, দু’হাত, দু’হাঁটু ও দু’পায়ের আংগুল সমূহের অগ্রভাগ সহ মোট ৭টি অঙ্গ মাটিতে লাগিয়ে সিজদা করবে।[117] সিজদায় যাওয়ার সময় প্রথমে দু’হাত মাটিতে রাখবে। কেননা এ বিষয়ে আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত وَلْيَضَعْ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ হাদীছটি ‘ছহীহ’।[118] কিন্তু ওয়ায়েল বিন হুজ্র (রাঃ) বর্ণিত আগে হাঁটু রাখার হাদীছটি ‘যঈফ’।[119] সিজদার সময় হাত দু’খানা ক্বিবলামুখী করে [120] মাথার দু’পাশে কাঁধ বা কান বরাবর[121] মাটিতে স্বাভাবিকভাবে রাখবে[122] এবং কনুই ও বগল ফাঁকা রাখবে। [123] হাঁটু বা মাটিতে ঠেস দিবে না।[124] সিজদায় দুই কনুই উঁচু রাখবে এবং কোনভাবেই দু’হাত কুকুরের মত মাটিতে বিছিয়ে দেওয়া যাবে না।[125]
সিজদা এমন (লম্বা) হবে, যাতে বুকের নীচ দিয়ে একটা বকরীর বাচ্চা যাওয়ার মত ফাঁকা থাকে।[126] সহজ হিসাবে প্রত্যেক মুছল্লী নিজ হাঁটু হ’তে নিজ হাতের দেড় হাত দূরে সিজদা দিলে ঠিক হ’তে পারে। সিজদা হ’তে উঠে বাম পায়ের পাতার উপরে বসবে এবং ডান পায়ের পাতা খাড়া রাখবে ও আঙ্গুলগুলি ক্বিবলামুখী রাখবে।[127]
অতঃপর বৈঠকের দো‘আ পাঠ শেষে তাকবীর বলে দ্বিতীয় সিজদায় যাবে। অনেক মহিলা সিজদায় গিয়ে মাটিতে নিতম্ব রাখেন। এই মর্মে ‘মারাসীলে আবুদাঊদে’ বর্ণিত হাদীছটি নিতান্তই ‘যঈফ’।[128] এর ফলে সিজদার সুন্নাতী তরীকা বিনষ্ট হয়। সিজদা হ’ল ছালাতের অন্যতম প্রধান ‘রুকন’। সিজদা নষ্ট হ’লে ছালাত বিনষ্ট হবে। অতএব এই বদভ্যাস এখনই পরিত্যাজ্য।
সিজদা হ’ল দো‘আ কবুলের সর্বোত্তম সময়। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
أَقْرَبُ مَا يَكُوْنُ الْعَبْدُ مِنْ رَّبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ رواه مسلم وفي رواية له عن ابن عباس قال : فَاجْتَهِدُوْا فِي الدُّعَاءِ فَقَمِنٌ أَنْ يُّسْتَجَابَ لَكُمْ-
‘বান্দা স্বীয় প্রভুর সর্বাধিক নিকটে পৌঁছে যায়, যখন সে সিজদায় রত হয়। অতএব তোমরা ঐ সময় বেশী বেশী প্রার্থনা কর’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমরা প্রার্থনায় সাধ্যমত চেষ্টা কর। আশা করা যায়, তোমাদের দো‘আ কবুল করা হবে’।[129] রুকূ ও সিজদাতে কমপক্ষে তিনবার তাসবীহ পাঠ করবে।[130] দশবার দো‘আ পাঠের যে হাদীছ এসেছে, তা যঈফ। [131]
দুই সিজদার মধ্যেকার সংক্ষিপ্ত বৈঠকে হাতের আঙ্গুলগুলি দুই হাঁটুর মাথার দিকে স্বাভাবিকভাবে ক্বিবলামুখী ছড়ানো থাকবে। [132] এই সময়ে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়বে-
দুই সিজদার মধ্যবর্তী বৈঠকের দো‘আ (الدعاء بين السجدتين) :
(পৃষ্ঠা ১৬ দ্রষ্টব্য) অথবা কমপক্ষে ২ বার বলবে ‘রবিবগ্ফিরলী’ (হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর)। [133] অতঃপর ২য় সিজদা করবে ও দো‘আ পড়বে।
জালসায়ে ইস্তেরা-হাত (جلسة الإستراحة) :
২য় ও ৪র্থ রাক‘আতে দাঁড়াবার প্রাক্কালে সিজদা থেকে উঠে সামান্য সময়ের জন্য স্থির হয়ে বসা সুন্নাত। একে ‘জালসায়ে ইস্তেরা-হাত’ বা স্বস্তির বৈঠক বলে। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنْ مَالِكِ بْنِ الْحُوَيْرِثِ أَنَّهُ رَأَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّيْ فَإِذَا كَانَ فِيْ وِتْرٍ مِّنْ صَلاَتِهِ لَمْ يَنْهَضْ حَتَّى يَسْتَوِيَ قَاعِدًا رواه البخارىُّ-
অর্থাৎ ‘ছালাতের মধ্যে যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বেজোড় রাক‘আতে পৌঁছতেন, তখন দাঁড়াতেন না যতক্ষণ না সুস্থির হয়ে বসতেন’। [134] একই রাবীর অন্য বর্ণনায় এসেছে,
وَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ عَنِ السَّجْدَةِ الثَّانِيَةِ جَلَسَ وَاعْتَمَدَ عَلَى الْأَرْضِ ثُمَّ قَامَ
‘যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দ্বিতীয় সিজদা হ’তে মাথা উঠাতেন তখন বসতেন এবং মাটির উপরে (দু’হাতে) ভর দিতেন। অতঃপর দাঁড়াতেন’। [135]
‘হাতের উপরে ভর না দিয়ে তীরের মত সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন’ বলে ‘ত্বাবারাণী কাবীরে’ বর্ণিত হাদীছটি ‘মওযূ’ বা জাল এবং উক্ত মর্মে বর্ণিত সকল হাদীছই ‘যঈফ’। [136]
ইসহাক্ব বিন রাহ্ওয়াইহ বলেন, যুবক হৌক বা বৃদ্ধ হৌক রাসূল (ছাঃ) থেকে এ সুন্নাত জারি আছে যে, তিনি প্রথমে মাটিতে দু’হাতে ভর দিতেন। অতঃপর দাঁড়াতেন। দশজন ছাহাবী কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে সত্যায়ন প্রাপ্ত আবু হুমায়েদ সা‘এদী (রাঃ) প্রদর্শিত ছালাতের প্রসিদ্ধ হাদীছেও এর স্পষ্ট দলীল রয়েছে। [137]
সিজদার ফযীলত (فضل السجدة) :
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ : مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْجُدُ لِلَّهِ سَجْدَةً إِلاَّ كَتَبَ اللهُ لَهُ بِهَا حَسَنَةً وَمَحَا عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةً وَرَفَعَ لَهُ بِهَا دَرَجَةً، فَاسْتَكْثِرُوْا مِنَ السُّجُوْدِ، رواه ابنُ ماجه-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করে, আল্লাহ তার জন্য একটি নেকী লেখেন ও তার একটি পাপ দূর করে দেন এবং তার মর্যাদার স্তর একটি বৃদ্ধি করে দেন। অতএব তোমরা বেশী বেশী সিজদা কর’।[138]
(২) ক্বিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈমানদারগণকে চিনবেন তাদের সিজদার স্থান ও ওযূর অঙ্গ সমূহের ঔজ্জ্বল্য দেখে’। [139]
(৩) আল্লাহ জাহান্নামবাসীদের মধ্য থেকে কিছু লোকের উপরে অনুগ্রহ করবেন এবং ফেরেশতাদের বলবেন, যাও ঐসব লোকদের বের করে নিয়ে এসো, যারা আল্লাহর ইবাদত করেছে। অতঃপর ফেরেশতাগণ তাদের সিজদার চিহ্ন দেখে চিনে নিবেন ও বের করে আনবেন। বনু আদমের সর্বাঙ্গ আগুনে খেয়ে নিবে, সিজদার চিহ্ন ব্যতীত। কেননা আল্লাহ পাক জাহান্নামের উপরে হারাম করেছেন সিজদার চিহ্ন খেয়ে ফেলতে’।[140]
সিজদার অন্যান্য দো‘আ সমূহের কয়েকটি :
1- اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لِيْ ذَنْبِيْ كُلَّهُ دِقَّهُ وَجِلَّهُ وَ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ وَعَلاَنِيَتَهُ وَسِرَّهُ (مسلم)-
2- سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ لآ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ (مسلم)-
3- اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لِيْ مَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ (النسائي والحاكم)-
4- اَللَّهُمَّ إنِّيْ أَعُوْذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ، وَأَعُوْذُ بِمُعَافَاتِكَ مِنْ عُقُوْبَتِكَ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْكَ، لاَ أُحْصِيْ ثَنَاءً عَلَيْكَ، أَنْتَ كَمَا أَثْنَيْتَ عَلَى نَفْسِكَ (مسلم)-
5- اَللَّهُمَّ لَكَ سَجَدْتُ، وَبِكَ آمَنْتُ، وَلَكَ أَسْلَمْتُ وَ أَنْتَ رَبِّىْ، سَجَدَ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ خَلَقَهُ وَصَوَّرَهُ فَأَحْسَنَ صُوَرَهُ وَشَقَّ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ، فَتَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِيْنَ (مسلم)- (صفة صلاة النبي r 127-129)-
১১. শেষ বৈঠক (القعدة الأخيرة)
যে বৈঠকের শেষে সালাম ফিরাতে হয়, তাকে শেষ বৈঠক বলে। এটি ফরয, যা না করলে ছালাত বাতিল হয়। তবে ১ম বৈঠকটি ওয়াজিব, যা ভুলক্রমে না করলে সিজদায়ে সহো ওয়াজিব হয়। ২য় রাক‘আত শেষে বৈঠকে বসবে। যদি ১ম বৈঠক হয়, তবে কেবল ‘আত্তাহিইয়া-তু’ পড়ে ৩য় রাক‘আতের জন্য উঠে যাবে। [141] আর যদি শেষ বৈঠক হয়, তবে ‘আত্তাহিইয়া-তু’ পড়ার পরে দরূদ, দো‘আয়ে মাছূরাহ এবং সম্ভব হ’লে অন্য দো‘আ পড়বে।[142] ১ম বৈঠকে বাম পা পেতে তার উপরে বসবে ও শেষ বৈঠকে ডান পায়ের তলা দিয়ে বাম পায়ের অগ্রভাগ বের করে দিয়ে বাম নিতম্বের উপরে বসবে ও ডান পায়ের পাতা খাড়া রাখবে। এই সময় ডান পায়ের আঙ্গুলী সমূহের অগ্রভাগ ক্বিবলামুখী থাকবে।[143] জোড়-বেজোড় যেকোন ছালাতের সালামের বৈঠকে নারী-পুরুষ সকলকে এভাবেই বাম নিতম্বের উপর বসতে হয়। একে ‘তাওয়ার্রুক’ (التورك) বলা হয়।[144]
বৈঠকের সময় বাম হাতের আঙ্গুলগুলো বাম হাঁটুর প্রান্ত বরাবর ক্বিবলামুখী ও স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে[145] এবং ডান হাত ৫৩ -এর ন্যায় মুষ্টিবদ্ধ থাকবে ও শাহাদাত অঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করবে।[146] বৈঠকের শুরু থেকে সালাম ফিরানোর আগ পর্যন্ত ইশারা করতে থাকবে।[147] ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৯০৪-৯৪ খৃ:) বলেন, আঙ্গুল ইশারার মাধ্যমে আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেওয়া হয়।[148] দো‘আ পাঠের সময় আকাশের দিকে তাকানো নিষেধ।[149] ইশারার সময় আঙ্গুল দ্রুত নাড়ানো যাবে না, যা পাশের মুছল্লীর দৃষ্টি কেড়ে নেয়’। [150] ‘আশহাদু’ বলার সময় আঙ্গুল উঠাবে ও ইল্লাল্লা-হ’ বলার পর আঙ্গুল নামাবে’ বলে যে কথা চালু আছে তার কোন ভিত্তি নেই।[151] মুছল্লীর নযর ইশারার বাইরে যাবে না। [152] এই সময় নিম্নোক্ত দো‘আসমূহ পড়বে-
(ক) তাশাহহুদ* (আত্তাহিইয়া-তু) : ( পৃষ্ঠা ১৬ দ্রষ্টব্য)
নবীকে সম্বোধন :
তাশাহহুদ সম্পর্কিত সকল ছহীহ মরফূ হাদীছে রাসূল (ছাঃ)-কে সম্বোধন সূচক ‘আইয়ুহান্নাবী’ শব্দ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) প্রমুখ কতিপয় ছাহাবী ‘আইয়ুহান্নাবী’-এর পরিবর্তে ‘আলান্নাবী’ বলতে থাকেন। যেমন বুখারী ‘ইস্তীযা-ন’ অধ্যায়ে এবং অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। অথচ সকল ছাহাবী, তাবেঈন, মুহাদ্দেছীন, ফুক্বাহা পূর্বের ন্যায় ‘আইয়ুহান্নাবী’ পড়েছেন। এই মতভেদের কারণ হ’ল এই যে, রাসূলের জীবদ্দশায় তাঁকে সম্বোধন করে ‘আইয়ুহান্নাবী’ বলা গেলেও তাঁর মৃত্যুর পরে তো আর তাঁকে ঐভাবে সম্বোধন করা যায় না। কেননা সরাসরি এরূপ গায়েবী সম্বোধন কেবল আল্লাহকেই করা যায়। মৃত্যুর পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এভাবে সম্বোধন করলে তাঁকে আল্লাহ সাব্যস্ত করা হয়ে যায়। সেকারণ কিছু সংখ্যক ছাহাবী ‘আলান্নাবী’ অর্থাৎ ‘নবীর উপরে’ বলতে থাকেন।
পক্ষান্তরে অন্য সকল ছাহাবী পূর্বের ন্যায় ‘আইয়ুহান্নাবী’ বলতে থাকেন। ত্বীবী (মৃ: ৭৪৩ হিঃ) বলেন, এটা এজন্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁদেরকে উক্ত শব্দেই ‘তাশাহহুদ’ শিক্ষা দিয়েছিলেন। তার কোন অংশ তাঁর মৃত্যুর পরে পরিবর্তন করতে বলে যাননি। অতএব ছাহাবায়ে কেরাম উক্ত শব্দ পরিবর্তনে রা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন