তাওহীদ রিসালাত ও আখিরাত
বিবেকের ফায়সালা
বড়
বড় শহর-নগরে আমরা দেখতে পাই, শত শত কারখানা বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্যে
চলছে। রেল ও ট্রাম-গাড়ি তীব্রভাবে ধাবমান। সন্ধ্যার সময় হাজার হাজার বিজলী
বাতি জ্বলে উঠে, গ্রীষ্মকালে প্রায় ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা চলে। কিন্তু এতোসব
কাজ দেখে আমাদের মনে যেমন কোনো বিস্ময়ের উদ্রেক হয় না, তেমনি এসব জিনিস
উজ্জ্বল ও তীব্র গতিসম্পন্ন হওয়ার মূল কারণ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনোরূপ
মতবৈষম্যেরও সৃষ্টি হয় না। এর কারণ কি?.........
এর একমাত্র কারণ এই
যে, যে বৈদ্যুতিক তারের সাথে এ বাতিগুলো যুক্ত রয়েছে, তা আমরা নিজেদের
চোখে দেখতে পাই। যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাথে এ তারগুলো সংযোজিত, তার
অবস্থাও আমাদের অজ্ঞাত নয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যারা কাজ করে, তাদের অস্তিত্ব
এবং বর্তমান থাকাও আমাদের জ্ঞানের আওতাভুক্ত। কর্মচারীদের উপর যে
ইঞ্জিনিয়ারের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত রয়েছে সে-ও আমাদের অপরিচিত নয়।
আমরা একথাও জানি যে, এ ইঞ্জিনিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্ণ
ওয়াকিফহাল। তার নিকট বিরাট যন্ত্র রয়েছে, এ যন্ত্র চালিয়ে সে বিদ্যুৎ শক্তি
উৎপাদন করে। বিজলী বাতির আলো, পাখার ঘুর্ণন, রেল ও ট্রাম-গাড়ির দ্রুত
গমন, চাকা ও কারখানা চলা ইত্যাদির মধ্যেই আমরা সেই বিদ্যুৎ শক্তির অস্তিত্ব
বাস্তবভাবে দেখতে পাই। কাজেই বিদ্যুৎ শক্তির ক্রিয়া ও বাহ্যিক নিদর্শনসমূহ
প্রত্যক্ষভাবে দেখে তার কার্যকারণ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে কোনো
মতবৈষম্যের সৃষ্টি না হওয়ার কারণ কেবল এটাই যে, এ কার্যকারণ পরস্পরা
সূত্রটিই আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূত এবং প্রত্যক্ষভাবে আমাদের গোচরীভূত রয়েছে।
মনে করুন, এই বিজলী বাতিগুলো যদি জ্বালানো হতো; পাখাগুলো ঘুরতো, রেল ও
ট্রাম-গাড়িগুলো দ্রুত চলতো, চাকা ও যন্ত্রদানব গতিশীল হতো, কিন্তু যে
তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ শক্তি পৌঁছায় তা যদি আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে থেকে
যেতো, বিদ্যুৎ কেন্দ্রও অনুভূতি শক্তির আয়ত্বের বাইরে থাকতো, বিদ্যুৎ
কেন্দ্রের কর্মচারীদের সম্পর্কেও আমরা যদি কিছুই জানতে না পারতাম এবং
কোন্ ইঞ্জিনিয়ার নিজের জ্ঞান ও শক্তির সাহায্যে এ কারখানাটি পরিচালনা
করছে, একথাও না জানতাম তা হলেও কি আমরা এমনিভাবে শান্ত মনে বসে থাকতে
পারতাম? তখন কি বৈদ্যুতিক শক্তির এ বাহ্যিক কার্যক্রম দেখে তার মূল
কার্যকারণ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হতো না? এর উত্তরে সকলেই
বলবেন, তখন আমাদের মধ্যে মতবৈষম্য না হয়ে পারতো না। কিন্তু কেন? এজন্য যে,
বাহ্যিক কার্যক্রমের কারণ যখন প্রচ্ছন্ন অগোচরীভূত ও অজ্ঞাত, তখন আমাদের
মনে বিস্ময়সূচক অস্থিরতার উদ্রেক হওয়া এ অজ্ঞাত রহস্যের দারোদঘাটনের জন্য
উদ্বিগ্ন ও ব্যতিব্যস্ত হওয়া এবং রহস্য সম্পর্কে ধারণা-অনুমান ও মতের
পার্থক্য সৃষ্টি হওয়া এক অতি স্বাভাবিক ব্যাপার।
একথাটি ধরে নেয়ার পর
আরো কয়েকটি কথা চিন্তা করুন। মনে করুন উপরে যে কথাগুলি ধরে নেয়া হয়েছে,
তাই বাস্তব জগতে বিদ্যমান। সহস্র-লক্ষ বিজলী বাতি জ্বলছে, লক্ষ পাখা
অহর্নিশ ঘুরছে, অসংখ্য গাড়ি দ্রুত দৌড়াচ্ছে, শত সহস্র কারখানা
নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছে। কিন্তু এগুলোতে কোন্ শক্তি কাজ করছে এবং সেই
শক্তিই বা কোথা হতে আসে, তা জানার কোনো উপায়ই আমাদের করায়ত্ব নয়, এসব
কর্মকাণ্ড ও বাহ্যিক লক্ষণ-নিদর্শন দেখে লোকদের মন হতচকিত ও স্তম্ভিত।
প্রত্যেক ব্যক্তিই উহার কার্যকারণের সন্ধানে বুদ্ধির ঘোড়া দৌঁড়াচ্ছে। কেউ
বলছেঃ এ সবকিছুই স্বতস্ফূর্তভাবে উজ্জ্বল আলোক মণ্ডিত এবং স্বীয় শক্তি
বলে চলমান, গতিশীল। এগুলোর নিজস্ব সত্ত্বার বাইরে এমন কোনো শক্তি নেই
যে, এগুলোকে আলো বা গতি দান করতে পারে। কেউ বলছেঃ এসব জিনিস যেসব বস্তু
হতে সৃষ্ট সেগুলোর সংযোজন ও সংগঠনই উহাদের মধ্যে আলো ও গতির উদ্ভব
করেছে। অন্য কারো মতে এ বস্তুজগতের বাইরে কতোক দেবতা রয়েছে, যাদের মধ্য
হতে কেউ বিজলী বাতি প্রজ্জ্বলিত করে, কেউ ট্রাম-রেলগাড়ি চালায়, কেউ
পাখাগুলোতে ঘূর্ণন ও আবর্তন ঘটায় এবং কারখানা ও যন্ত্রের চাকাকে গতিশীল
করে। অনেক লোক আবার এ বিষয়টি চিন্তা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এবং শেষ
পর্যন্ত কাতর হয়ে বলতে শুরু করেছে যে, আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি সূক্ষ্ম ও গভীর
রহস্যাবৃত তত্ত্ব পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। আমরা শুধু এতোটুকু জানতে পারি
যতোটুকু আমরা নিজেদের চোখে দেখতে পাই ও অনুভব করতে পারি। তার অধিক কিছু
আমরা বুঝতে পারি না। আর যা আমাদের বোধগম্য নয়, আমরা উহার সত্যতাও যেমন
স্বীকার করতে পারি না, তেমনি পারি না উহার মিথ্যা বলে অস্বীকার করতে।
এসব
লোক পরস্পরের সাথে লড়াই-ঝগড়া করে বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে কারো নিকট
নিজস্ব চিন্তা ও মতের সমর্থনে এবং অপরের চিন্তা ও মতের প্রতিবাদ করার জন্য
নিছক ধারণা-অনুমান ছাড়া নির্দিষ্ট ও সন্দেহমুক্ত জ্ঞান বলতে কিছুই নেই।
এসব
মতবিরোধ ও মতবৈষম্য চলাকালে এক ব্যক্তি এসে বলে, সঠিক জ্ঞানের এমন একটি
সূত্র আমার নিকট আছে, যা তোমাদের কারো কাছে নেই। আমি সেই সূত্রে জানতে
পেরেছি যে, এসব বিজলী বাতি, বৈদ্যুতিক পাখা, গাড়ি, কারখানা ও যন্ত্রের চাকা
এমন কতোগুলো প্রচ্ছন্ন সূক্ষ্ম তারের সাথে সংযুক্ত, যা তোমরা (কেউ)
দেখতে পাওনা, অনুভবও করতে পারনা। একটি বিরাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র (power house)
হতে এসব তারে শক্তি সঞ্চারিত হয়, উহাই আলো ও গতিরূপে তোমাদের সামনে
অভিব্যক্ত হয়। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বড় বড় যন্ত্র সংস্থাপিত রয়েছে, যাকে
অসংখ্য ব্যক্তি চালাচ্ছে। এ ব্যক্তিগণ আবার একজন ইঞ্জিনিয়ারের অধীনে এবং এ
ইঞ্জিনিয়ারের জ্ঞান ও শক্তিই এ সমগ্র ব্যবস্থাকে কায়েম করেছে, তারই
পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে এ সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে।
এ ব্যক্তি
পূর্ণ শক্তিতে তার উপরোক্ত দাবি পেশ করে। লোকেরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে
আখ্যায়িত করে। সকল দল একযোগে তার বিরোধিতা করে। তাকে পাগল বলে, আঘাত করে,
মারপিট করে, কষ্ট দেয়, ঘর হতে বের করে দেয়। কিন্তু এসব অমানুষিক ও দৈহিক
উৎপীড়ন সত্ত্বেও সে নিজের দাবির উপর শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। কোনো প্রকার
ভয়-ভীতি কিংবা প্রলোভনে পড়ে নিজের মূল কথার এক বিন্দু পরিমাণ রদবদল বা
সংশোধন করতে প্রস্তুত হয়না। কোনো প্রকার বিপদেও তার দাবিতে কোনো
দুর্বলতা দেখা যায়না। উপরন্তু তার প্রত্যেকটি কথাই প্রমাণ করে যে, তার কথার
সত্যতার উপর তার দৃঢ় প্রত্যয় বিদ্যমান।
এরপর আর এক ব্যক্তি এসে
উপস্থিত হয়। সে-ও ঠিক একথাই অনুরূপ দাবি সহকারে পেশ করে। তারপর তৃতীয়,
চতুর্থ, পঞ্চম ব্যক্তি এসেও পূর্ববর্তীদের মতোই কথা বলে নিজের দাবি
উপস্থিত করে। অতপর এ ধরনের লোকদের আগমন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এমনকি
তাদের সংখ্যা শত সহস্রকেও অতিক্রম করে যায়, আর এসব লোকই সেই এক প্রকারের
কথাকে একই ধরনের দাবি সহকারে উপস্থাপন করে। স্থান কাল ও অবস্থার পার্থক্য
থাকা সত্ত্বেও তাদের মূল কথায় কোনোই পার্থক্য সূচিত হয়না। সকলেই বলেঃ
আমাদের কাছে জ্ঞানের এমন এক বিশেষ সূত্র বিদ্যমান, যা অপর কারো কাছে নেই। এ
সকল লোককে সমানভাবে পাগল বলে আখ্যা দেয়া হয়। সকল প্রকার
নির্যাতন-নিষ্পেষণে তাদেরকে জর্জরিত করে তোলা হয়। সকল দিক দিয়েই তাদেরকে
কোণঠাসা ও নিরূপায় করে দেবার চেষ্টা করা হয়। তাদের কথা ও দাবি হতে তাদেরকে
বিরত রাখার উদ্দেশ্যে সকল প্রকার উপায় অবলম্বন করা হয়। কিন্তু তাদের সকলেই
নিজের কথার উপর অটল হয়ে থাকে। দুনিয়ার কোনো শক্তিই তাদেরকে এক ইঞ্চি
পরিমাণ স্থান পর্যন্ত সরাতে পারেনা। এ সংকল্প, দৃঢ়তা ও স্থির সততার সাথে
তাদের বিশেষ কতোগুলো গুনের ও বৈশিষ্ট্যের সংযোগ হয়। তাদের মধ্যে একজনও
মিথ্যাবাদী, চোর, বিশ্বাস ভংগকারী, চরিত্রহীন, অত্যাচারী ও হারামখোর নয়।
তাদের শত্রু এবং বিরোধীরাও একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, এই লোকদের চরিত্র
অত্যন্ত পবিত্র, স্বভাব অতিশয় নির্মল ও পূণ্যময়। নৈতিক সৌন্দর্য ও স্বভাব
বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে এরা অপর লোকদের তুলনায় উন্নত এবং বিশিষ্ট স্থানের
অধিকারী। এছাড়া তাদের মধ্যে পাগলামীরও কোনো লক্ষণ দেখা যায়না। বরং উহার
বিপরীতে চরিত্র সংশোধন ও মন পরিশুদ্ধকরণ এবং বৈষয়িক কায়কারবারগুলোর
সংশোধন সম্পর্কে এমন সব উন্নত শিক্ষা তারা পেশ করেন, এমন সব আইন-কানুন ও
নিয়ম-নীতি রচনা করেন, যার সমান আইন রচনা করা তো দূরের কথা, তার সূক্ষ্মতা
অনুধাবন করার জন্যেও বড় বড় পণ্ডিত মনীষীগণকে গোটা জীবন অতিবাহিত করে দিতে
হয়।
একদিকে সেই বিভিন্ন চিন্তা ও মতের লোক যারা এই লোকদের কথাকে
মিথ্যা মনে করছে, এর সত্যতা অস্বীকার করছে, আর অপর দিকে রয়েছে এ ঐকমত্য
পোষণকারী দাবীদারগণ। এ উভয়েরই ব্যাপারটি সুস্থ ও সঠিক জ্ঞান-বুদ্ধির
আদালতে বিচার মীমাংসার উদ্দেশ্যে পেশ করা হয়। বিচারক হিসাবে বুদ্ধির
কর্তব্য হচ্ছে প্রথমত স্বীয় অবস্থাকে খুব ভালো করে বুঝে নেয়া ও যাচাই করা।
তার কর্তব্য পক্ষদ্বয়ের অবস্থাকে তুলনামূলকভাবে অনুধাবন করা এবং উভয়ের
মধ্যে তুলনা ও যাচাই পরখ করার পর কার কথা গ্রহণযোগ্য তার চূড়ান্ত
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
বিচারকের বিবেকের অবস্থা এই যে, প্রকৃত
ব্যাপারটিকে সঠিকরূপে জেনে নেবার কোনো সূত্রই তার করায়ত্ব নয়। প্রকৃত
নিগূঢ় সত্যের (ultimate reality) কোনো জ্ঞানই তার নেই। তার সামনে
পক্ষদ্বয়ের বর্ণনা-বিবৃতি, যুক্তি-প্রমাণ, তাদের নিজস্ব অবস্থা ও বাহ্যিক
লক্ষণ নিদর্শনই শুধু বর্তমান। তাকে গভীর তত্ত্বানুসন্ধিৎসুর দৃষ্টিতে যাচাই
করে সম্ভাব্য অধিক সত্য কি হতে পারে তার ফায়সালা করতে হবে। কিন্তু
সম্ভাব্য অধিক সত্য হওয়ার দৃষ্টিতেও সে কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে পারে
না। কেননা যা কিছু তত্ত্ব ও তথ্য তার করায়ত্ব তার ভিত্তিতে প্রকৃত ব্যাপার
যে কি, তা বলাও তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। খুব বেশি হলে তার পক্ষে পক্ষদ্বয়ের
মধ্যে একটিকে অগ্রাধিকার দান করা সম্ভব। কিন্তু পূর্ণ নিশ্চয়তা ও দৃঢ়
প্রত্যয় সহকারে কাউকে সত্য বলা বা কাউকেও মিথ্যা বলে অভিহিত করা তার পক্ষে
সম্ভব নয়।
যারা উক্ত কথা ও দাবির সত্যতা অস্বীকার করে তাদের অবস্থা
নিম্নরূপঃ একঃ প্রকৃত নিগূঢ় সত্য সম্পর্কে তাদের মতাদর্শ বিভিন্ন। কোনো
একটি বিষয়েও তাদের মধ্যে মতঐক্য দেখতে পাওয়া যায়না।
দুইঃ তারা
নিজেরাই একথা বলে যে, প্রকৃত সত্যকে জানার জন্য বিশেষ কোনো জ্ঞান-সূত্রও
তাদের মধ্যে বর্তমান নেই। তাদের মধ্যে কোনো কোনো দল শুধু এতোটুকু
মাত্র দাবি করে যে, তাদের আন্দায-অনুমান অপর লোকদের আন্দায-অনুমানের
তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ, এছাড়া আর কোনো জিনিসেরই তাদের কোনো দাবি
নেই। কিন্তু তাদের ধারণা-অনুমানগুলো যে নিছক ধারণা অনুমানই এর বেশি কিছু
নয়, সে কথাও সকলে এক বাক্যে স্বীকার করে।
তিনঃ তাদের ধারণা-অনুমানের
উপর তাদের বিশ্বাস, ঈমান ও প্রত্যয় অটল দৃঢ়তা পর্যন্ত পৌঁছেনি, মত
পরিবর্তনের অনেক দৃষ্টান্তও তাদের মধ্যে বর্তমান। অনেক সময় দেখা গেছে যে,
এক একজন ব্যক্তি দীর্ঘকাল পর্যন্ত যে মত পূর্ণ প্রত্যয় সহকারে পোষণ ও
প্রচার করতো, পরের দিনই সে তার পুরাতন মতের প্রতিবাদ ও এক নতুন মত প্রচার
করতে শুরু করেছে। বয়স, জ্ঞান-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার ক্রমোন্নতির সাথে সাথে
প্রায়ই তাদের মত যে পরিবর্তিত হয়, তা এক প্রমাণিত সত্য।
চারঃ
উপরোক্ত কথা অস্বীকারকারীদের কাছে একথাকে অস্বীকার করার স্বপক্ষে এতোটুকু
মাত্র যুক্তি রয়েছে যে, তারা নিজেদের কথার সত্যতার অনুকূল কোনো
সন্দেহমুক্ত সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। তার সেই গোপন ‘তার’
তাদেরকে দেখায়নি যার সাথে এ বিজলী বাতি ও পাখা ইত্যাদি যুক্ত রয়েছে বলে
তারা দাবি করে। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে
বিদ্যুতের অস্তিত্বও তাদেরকে দেখানো হয়নি। বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিভ্রমণেরও
কোনো ব্যবস্থা করেনি, এর কল-কারখানা এবং যন্ত্রও দেখায়নি। সেখানকার
কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাত হয়নি, ইঞ্জিনিয়ারের সাথেও কখনো সাক্ষাত করায়নি।
এমতাবস্থায় এগুলোর অস্তিত্ব ও সত্যতাকে আমরা কিভাবে মেনে নিতে পারি।
যারা উক্ত কথার দাবি পেশ করছে তাদের অবস্থা নিম্নরূপঃ
একঃ
একথার দাবি যারা পেশ করেছেন তারা সকলেই সর্বোতভাবে একমত। মূল দাবির
অন্তর্নিহিত যতো নিগূঢ় কথা ও দিক তার সব বিষয়েই তাদের মধ্যে পূর্ণ মতৈক্য
বিদ্যমান রয়েছে।
দুইঃ তাদের সকলেরই সর্বসম্মত ঐক্যবদ্ধ দাবি এই যে, তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞানের এমন একটি সূত্র রয়েছে, যা সাধারণ লোকদের আয়ত্বাধীন নয়।
তিনঃ
তাদের মধ্যে একথা কেউ বলেননি যে, তারা একথা শুধু ধারণা-অনুমানের ভিত্তিতে
বলছে এবং সকলেই পূর্ণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে একথা বলছে যে, ইঞ্জিনিয়ারের সাথে
তাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে, তার কর্মচারীগণ তাদের নিকট আসা যাওয়া করে, তার
কারখানা পরিভ্রমণেও তাদেরকে সুযোগ দেয়া হয়েছে। এবং তারা যা কিছু বলে, তা
সন্দেহমুক্ত জ্ঞান ও দৃঢ় প্রত্যয় সহকারেই বলে, ধারণা অনুমানের ভিত্তিতে নয়।
চারঃ তাদের মধ্যে কেউ নিজের কথা ও দাবিতে বিন্দু পরিমাণও রদ-বদল করেছে,
এরূপ একটি দৃষ্টান্তও পেশ করা যেতে পারেনা। তাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তিই
জীবনের সূচনা হতে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত একই কথা বলেছেন।
পাঁচঃ তাদের
চরিত্র চূড়ান্ত পর্যায়ে পবিত্র। মিথ্যা, ধোঁকা-প্রতারণা, শঠতা, দাগাবাযীর
বিন্দু পরিমাণ সম্পর্কও তাদের চরিত্রে নেই। আর জীবনের সমগ্র ব্যাপারে তারা
সত্যনিষ্ঠ ও খাঁটি, তারা এ ব্যাপারে সকলে মিলে যে মিথ্যা বলবে এর যুক্তিগত
কারণ কিছুই নেই।
ছয়ঃ এরূপ দাবি করে তারা ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ
উদ্ধার করতে চেয়েছে- এরূপ কোনো প্রমাণও পেশ করা যেতে পারে না। বরং
বিপরীতে এই অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যে, তাদের অধিকাংশ এ দাবির কারণে অমানুষিক
কষ্ট ও নির্যাতন ভোগ করেছেন, সম্মুখীন হয়েছেন কঠিন বিপদ-মুসিবতের। সে জন্য
তারা দৈহিক কষ্ট ভোগ করেছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন, আহত ও প্রহৃত হয়েছেন, দেশ
হতে নির্বাসিত ও বহিষ্কৃত হয়েছেন। অনেককে হত্যাও করা হয়েছে। এমনকি কাউকে
কাউকে করাত দ্বারা দু টুকরা করা হয়েছে। কয়েকজন ছাড়া কারো পক্ষেই স্বচ্ছল ও
সুখী জীবন যাপন করা সম্ভব হয়নি। কাজেই এ কাজের পশ্চাতে কোনো ব্যক্তিগত
স্বার্থ নিহিত রয়েছে, এরূপ অভিযোগ আরোপ করা যায়না। বরং এরূপ প্রতিকূল
অবস্থায় নিজের কথা ও দাবির উপর অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই নিঃসন্দেহে প্রমাণ
করে যে, তাদের সত্যতা সম্পর্কে তাদের চূড়ান্ত পর্যায়ের বিশ্বাস ও আস্থা
ছিলো। এমন বিশ্বাস ও আস্থা যে, নিজের প্রাণ বাঁচাইবার উদ্দেশ্যও তাদের কেউ
নিজ দাবি প্রত্যাহার করতে প্রস্তুত হয়নি।
সাতঃ তারা পাগল-বুদ্ধি
বিবর্জিত ছিলো বলেও কোনো প্রমাণ নেই। জীবনের সমগ্র ব্যাপারে তারা সকলেই
চূড়ান্ত পর্যায়ের বুদ্ধিমান ও সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন প্রমাণিত হয়েছে। তাদের
বিরোধীরাও প্রায়ই তাদের জ্ঞান ও বুদ্ধির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে।
এমতাবস্থায় এ বিশেষ ব্যাপারে তাদের পাগল বলে কিরূপে বিশ্বাস করা যেতে পারে?
বিশেষত এ ব্যাপারটি যে কি, তাও চিন্তা করা আবশ্যক। এ বিষয়টি তাদের জন্য
জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছিল। এরই জন্য তারা বছরের পর বছর ধরে
দুনিয়ার সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিল। সেটাই ছিলো তাদের বুদ্ধিসম্পন্ন
শিক্ষার মূলনীতি। যাদের বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ার কথা বিরুদ্ধবাদীরাও স্বীকার
করতে বাধ্য হয়েছে।
আটঃ তারা নিজেরাও এটা বলেনি যে, আমরা বিদ্যুৎ
কেন্দ্রের ইঞ্জিনিয়ার বা সেখানকার কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাত করাতে পারি।
কিংবা তার গোপন কারখানাও দেখাতে পারি। অথবা বাস্তব অভিজ্ঞতা ও
পর্যবেক্ষণের সাহায্যে আমাদের দাবির যথার্থতাও প্রমাণ করতে পারি। তারা
নিজেরা এ সমস্ত বিষয়কে ‘অদৃশ্য’ বলেই অভিহিত করে। তারা বলেঃ তোমরা আমাদের
উপর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করো এবং আমরা যা কিছু বলছি, তা মেনে নেও।
পক্ষদ্বয়ের আস্থা ও উভয়ের বক্তব্য সম্পর্কে চিন্তা করার পর বুদ্ধির আদালত নিম্নরূপ ফায়সালা করছেঃ
বুদ্ধি
বলে কয়েকটি বাহ্যিক লক্ষণ, নিদর্শন ও দর্শনে ওগুলোর আভ্যন্তরীণ কার্যকারণ
অনুসন্ধান কাজ উভয় পক্ষই করেছে এবং উভয় পক্ষই নিজ নিজ মতবাদ প্রকাশ করেছে।
বাহ্যদৃষ্টে উভয় পক্ষের মতবাদ একটি দিক দিয়ে সমান ও ‘একই রকম’ মনে হয়।
প্রথমত উভয় পক্ষের কারো মতে বুদ্ধির বিচারে ‘অসম্ভবতা’ নেই। অর্থাৎ
বুদ্ধির নিয়ম-নীতির দৃষ্টিতে কোনো একটি মত সম্পর্কে একথা বলা যায় না যে,
উহার নির্ভুল ও সত্য হওয়া একেবারে অসম্ভব। দ্বিতীয়ত উভয় পক্ষের কারো কথায়
সত্যতা ও যথার্থতা বাস্তব অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণের সাহায্যে প্রমাণ করা
যায় না। প্রথম পক্ষের লোকেরাও যেমন নিজেদের সমর্থনে না এমন কোনো
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পেশ করতে সমর্থ হয়েছে, যা প্রত্যেক ব্যক্তিকে সত্য বলে
বিশ্বাস করতে বাধ্য করবে। তেমনি দ্বিতীয় পক্ষও না এরূপ প্রমাণ পেশ করতে
সমর্থ, না এরূপ প্রমাণ করার দাবি করে। কিন্তু আরো অধিক চিন্তা ও গবেষণার
পর এমন কয়েকটি বিষয় সুপ্রতিভাত হয়ে উঠে এবং উহার ভিত্তিতে দ্বিতীয় পক্ষের
‘মতবাদ’ অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়।
প্রথমঃ অপর কোনো
মতবাদের পক্ষে ও সমর্থনে এতো বিপুল সংখ্যক বুদ্ধিমান, পবিত্র
স্বভাব-চরিত্র সম্পন্ন, সত্যবাদী লোক এতো জোরালোভাবে, এতো দৃঢ় বিশ্বাস
এবং প্রত্যয় সহকারে প্রচার ও সমর্থন করেনি।
দ্বিতীয়ঃ এরূপ স্বভাবের
লোকেরাও বিভিন্ন কালের ও বিভিন্ন স্থানের। এরা সম্মিলিতভাবে দাবি করেছে
যে, তাদের সকলেরই নিকট এক অসাধারণ জ্ঞান-সূত্র বিদ্ধমান এবং তারা সকলেই এই
সূত্রের মাধ্যমে বাহ্যিক নিদর্শনসমূহের অন্তর্নিহিত কারণসমূহ জানতে পেরেছে।
কেবলমাত্র এতোটুকু জিনিসই আমাদেরকে তাদের দাবির সত্যতা স্বীকার করে নিতে
উদ্বুদ্ধ করে। বিশেষভাবে এ কারণে যে, তাদের জ্ঞান তথ্য সম্পর্কে তাদের
পরস্পরের বর্ণনার মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই। যা কিছু জ্ঞান-তথ্যের কথা
তারা প্রকাশ করেছে, তাতে বুদ্ধিগত অসম্ভবতাও কিছু নেই। কোনো লোকের মধ্যে
কিছু অনন্য সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি বর্তমান থাকা, যা অপর কারো মধ্যে পাওয়া
যায় না বুদ্ধির বিচারে অসম্ভব মনে করারও কোনো কারণ নেই।
তৃতীয়ঃ
বাহ্যিক নিদর্শনসমূহের অবস্থা চিন্তা করলেও এটাই স্বাভাবিক মনে হয় যে,
দ্বিতীয় পক্ষের মতবাদই ঠিক। কেননা বিজলী বাতি, পাখা, গাড়ি, কারখানা ইত্যাদি
স্বতই উজ্জ্বল ও গতিশীল হতে পারেনা। এরূপ হলে উজ্জ্বল ও গতিশীল হওয়া তাদের
নিজস্ব ইখতিয়ারভুক্ত হতো। আর তা যে নয়, বলাই বাহুল্য। অনুরূপভাবে তাদের
আলো ও গতি তাদের বস্তুগত সংগঠনেরও ফল নয়। কেননা তা যখন গতিশীল ও উজ্জ্বল
হয়না তখনও তো তাদের বস্তুগত সংগঠন এরূপ বর্তমান থাকে। আর এসব যে বিভিন্ন
শক্তির অধীনও নয়, তাও সুস্পষ্ট। কেননা বাতিসমূহের যখন আলো থাকে না, তখন
পাখাও বন্ধ থাকে, ট্রাম গাড়িও বন্ধ হয়ে যায়, কারখানাও তখন চলে না, এটা
সচরাচরই পরিদৃষ্ট হয়। কাজেই বাহ্যিক নিদর্শনসমূহের বিশ্লেষণ দানে প্রথম
পক্ষের তরফ হতে যেসব মতবাদ পেশ করা হয়েছে, তা সবই জ্ঞান-বুদ্ধি ও
বিবেক-বিচারের দৃষ্টিতে গ্রহণের অযোগ্য। সর্বাপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধ ও
নির্ভুল কথা এটাই মনে হয় যে, এ সমস্ত নিদর্শনেই একটি শক্তি সক্রিয় রয়েছে
এবং তার মূলমন্ত্র এক ‘সুবিজ্ঞ শক্তিমান ও বুদ্ধিমান’ সত্ত্বার হাতে
নিবদ্ধ, তিনি এক ‘সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা’ অনুযায়ী এ শক্তিকে বিভিন্ন
নিদর্শনের ক্ষেত্রে ব্যয় করছেন।
তবে সংশয়বাদীরা বলে থাকে যে, যেকথা
আমাদের বোধগম্য হয় না, আমরা তাকে না সত্য বলে গ্রহণ করতে পারি আর না
মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করতে পারি। বিচার- বুদ্ধি একথাকে সত্য বলে মেনে
নিতে পারে না। কেননা, কোনো একটি কথার বাস্তবে সত্য হওয়া তার শ্রোতাদের
বোধগম্য হওয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। কেবলমাত্র নির্ভরযোগ্য বিপুল সাক্ষ্য
হওয়াই তার বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়ার জন্য যথেষ্ট। আমাদের নিকট কয়েকজন
বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য লোক যদি বলে যে, আমরা পশ্চিম দেশে লোকদেরকে লৌহ
নির্মিত গাড়িতে বসে শূন্যলোকে উড়তে দেখেছি এবং লন্ডনে বসে আমাদের নিজেদের
কানে আমেরিকার বক্তৃতা শুনে এসেছি, তবে আমরা শুধু দেখবো যে, এ লোকগুলো
মিথ্যাবাদী বা বিদ্রূপকারী তো নয়? এরূপ বলার সাথে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ
তো কিছু জড়িত নেই? আমরা যদি দেখি যে, বহুসংখ্যাক সত্যবাদী ও বুদ্ধিমান
লোক কোনোরূপ মতদ্বৈততা ছাড়াই এবং পূর্ণ দায়িত্ব সহকারে একথা বলছে, তাহলে
আমরা পূর্ণ প্রত্যয় সহকারে তা অবশ্যই মেনে নিবো। লৌহ নির্মিত গাড়ির
শূন্যলোকে উড়ে যাওয়া এবং কোনো প্রকার বন্তুগত মাধ্যম ছাড়াই এক দেশের
ধ্বনি কয়েক সহস্র মাইল দূরবর্তী কোনো দেশে শ্রুত হওয়ার ব্যাপারটি আমাদের
বোধগম্য না হলেও তা আমরা বিশ্বাস করবো।
আলোচ্য ‘মামলায়’ বুদ্ধির
ফায়সালা এটাই। কিন্তু মনের সত্য বিশ্বাস ও প্রত্যয়মূলক অবস্থা ইসলামী
পরিভাষায় যাকে ঈমান বলা হয় এরূপ ফায়সালা হতে লাভ করা যায় না। এর জন্য
প্রয়োজন আন্তরিক নিষ্ঠাপূর্ণ অনুভূতি,দরকার মন লাগিয়ে দেয়ার, সেজন্য
হৃদয়ের অভ্যন্তরের গভীর মর্মমূল হতে এক ধ্বনি উত্থিত হওয়ার প্রয়োজন যা
মিথ্যা, সংশয়, সন্দেহ ও ইতস্তত করার সকল অবস্থার চির অবসান করে দিবে।
পরিষ্কার বলে দিবে, লোকদের ধারনা অনুমান, চিন্তা-কল্পনা ভুল বাতিল।
সত্যবাদী লোকেরা যা আন্দায করে নেয় নির্ভুল জ্ঞান ও অনাবিল অন্তদৃêষ্টির
ভিত্তিতে তাই সত্য, তা-ই নির্ভুল।
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন